আমি বেচতাছি তরকারি। তহন দারোগা সাহেব ও মালু ডাক দিয়ে বলে, মালামাল পরে মাপো; এদিকে আসো। কথামতো গেলে দারোগা স্যার জানতে চান তোমার বাড়ি কই। আমি বলি কুড়িগ্রাম। স্যার বলেন, আলমগীরকে একটা উপকার করে দেব। এ জন্য তোমার একটা স্বাক্ষর লাগবে। আমি জিগাই কিসের উপকার। জবাব দেন, সমস্যা নাই। দিয়ে দাও। পুলিশের ভয় ও মসজিদের ক্যাশিয়ার মালুর কথায় স্বাক্ষর দিয়া দিই। আমি কি জানি উপকারের নামে আলমগীরের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দেবে।’
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ সানারপাড় বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন লন্ডন মার্কেটের সামনে ভ্যানে সবজি বিক্রেতা মো. জহিরুল।প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সবজি বিক্রেতা জহিরুল, মামুনুর রহমান মালু এবং পুলিশের এক কনস্টেবলের সাক্ষ্যে কাজী আলমগীর হোসেন এখন কারাগারে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ৬০০ পুরিয়া (৬০ গ্রাম) কথিত হেরোইন উদ্ধার।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পুলিশের দায়ের করা মামলায় যে স্থানে হেরোইন উদ্ধার বা আলমগীরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে মামলার এজাহারের কোনো মিল নেই। এমনকি পুলিশের কনস্টেবল ছাড়া অপর দুই সাক্ষী জহিরুল এবং মামুনুর রহমান মালুও জানেন না কখন, কীভাবে আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আলমগীর এলাকায় মাদক বিক্রি করেন এমন তথ্যও নেই দুই সাক্ষীর কাছে। তাদের ভাষ্য, প্রতারণামূলক ও ভীতির সঞ্চার করে পুলিশ তাদের কাছে রাস্তা থেকে স্বাক্ষর নিয়ে অজান্তে মাদক মামলায় একজনকে আসামি করেছে। যে স্থানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটি ডেমরা বা ঢাকা মহানগরের বাইরে নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মধ্যে পড়েছে।
আসামির পরিবারের ভাষ্য, পুলিশের স্থানীয় সোর্স হিসেবে পরিচিত ‘সুজা’র প্ররোচনায় গত ১৬ এপ্রিল বা রমজানের শুরুতে আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে ডেমরা থানার এসআই সেলিম ও এএসআই আবুবকরের নেতৃত্বে একটি টিম। এর পর তাকে মাদকসহ ভয়ঙ্কর মামলায় ফাঁসানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে ২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। তিনি ৯০ হাজার টাকা দিলেও আধা কেজি গাঁজা উদ্ধারের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। কারামুক্তি পেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বরাবর একটি অভিযোগ করেন আলমগীর। ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত প্রত্যাশী তারা। কিন্তু থানা পুলিশকে রক্ষায় ডেমরা জোনের এডিসি দীন মোহাম্মদ সশরীরে গিয়ে নতুন হেরোইনের নাটক করে গ্রেপ্তার করেন আলমগীরকে। আবার কারাগারে যেতে হয় নির্দোষ আলমগীরকে- অভিযোগ আলমগীরের স্ত্রী রানী বেগমের।
গত ২২ মে ডেমরার মধ্য সানারপাড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আলমগীর হোসেনকে (৩৮)। ডেমরা থানার এসআই মো. আশরাফ আলীর করা মামলায় বলা হয়েছে, ‘ওইদিন দুপুর ২টার দিকে ডগাইর বাজার এলাকায় অবস্থানকালে বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, সানারপাড় মদিনা ট্যাংক রোডে ‘ফাতেমা স্টোর’ নামক মুদি দোকানের পশ্চিম পাশে পাকা রাস্তার ওপর এক লোক মাদকদ্রব্য বিক্রির জন্য অবস্থান করছে।’
‘পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে উপস্থিতি টের পেয়ে একজন পালানোর চেষ্টাকালে সঙ্গীয় অফিসার ও ফোর্সের সহায়তায় আসামিকে আটক করি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাক্ষী মামুুনুর রহমান মালু (৪২), মো. জহিরুল (৪৫) এবং পুলিশ কনস্টেবল আবদুল কাদেরের সামনে গ্রেপ্তার আসামির দেহ তল্লাশি করে লুঙ্গির ডান কোচরে পলিথিনে মোড়ানো ৬০০ পুরিয়া (৬০ গ্রাম) হেরোইন উদ্ধার করি। যার বাজারমূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা’- বলা হয় এজাহারে। তবে আলমগীর হোসেনকে গ্রেপ্তারের সময় সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজ এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ফুটেজে দেখা গেছে, দোকানের সামনেই পুলিশের একটি পিকআপ দাঁড় করানো। দোকান থেকে জোর জবরদস্তি করে তুলে নেওয়া হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার সানারপাড়ের বাসায় কথা হয় পুলিশের এজাহারে ঘটনাস্থলে উপস্থিত দেখানো সাক্ষী মো. জহিরুলের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ওইদিন রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে তিনি স্থানীয় লন্ডন মার্কেটের সামনে সবজি বিক্রি করছিলেন। তখন এসআই আশরাফ আলী তাকে ডেকে নিয়ে জানতে চান আলমগীর হোসেনকে চিনেন কিনা। জবাবে হ্যাঁ বললে, আলমগীরের উপকারের জন্য একটি স্বাক্ষর চান। এ সময় কিছু না জেনে এবং ‘সানারপাড় দৌলেশ্বর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের’ ক্যাশিয়ার মামুুনুর রহমান মালুর পাশে থেকে আশ্বস্ত করায় তিনি স্বাক্ষর দেন। তবে ঘটনাস্থলে তিনি ছিলেন না বা আলমগীরের মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে কিছু জানেন না- জানান সাক্ষী জহিরুল।
মামুুনুর রহমান মালু বলেন, ‘এসআই আশরাফ মাঝে-মধ্যে লন্ডন মার্কেটসংলগ্ন মসজিদ এলাকায় আসেন, তাকে চা-নাস্তা দেন। তাদের মধ্যে অনেক দিনের সম্পর্ক। সেই সুবাদে ওইদিন রাত পৌনে নয়টার দিকে এসআই আমাকে বলেন, আলমগীরকে চেনেন। আমি হ্যাঁ বলি, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। তখন এসআই বলেন একটি সাক্ষ্য দেন। কিসের সাক্ষ্য জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, সমস্যা নাই। জীবনে এই একটাই সাক্ষ্য দিয়েছি। সেটা যে মাদক মামলার, সে ব্যাপারে কিছুই জানলাম না। ঘটনাস্থলেও ছিলাম না।’
দুই সাক্ষীর একজনও জানেন না মামলার তথ্য, ছিলেন না ঘটনাস্থলে উপস্থিত তা হলে কীভাবে সাক্ষী করা হলো। আবার গ্রেপ্তারের স্থানের সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজের মিল নেই। এসব প্রশ্ন করা হয় মামলার বাদী এসআই মো. আশরাফ আলীর কাছে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এ বিষয়ে এডিসি স্যারকে (দীন মোহাম্মদ) জিজ্ঞাসা করেন। তিনি গ্রেপ্তারের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে পুলিশের ওয়ারি বিভাগের (ডেমরা জোন) এডিসি দীন মোহাম্মদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আপনারা কি চান না আমরা মাদক মামলার তদন্ত করি। তা হলে প্রশ্ন করছেন কেন? সাক্ষীকে নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যান। আপনি আমার অফিসে আসেন।’
গ্রেপ্তার আলমগীর হোসেনের স্ত্রী রানী বেগম বলেন, ১৬ এপ্রিল তার স্বামী আলমগীর মুদি দোকানে মালামাল বিক্রি করছিলেন। এ সময় ডেমরা থানার এসআই সেলিম ও এএসআই আবুবকরসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আসেন। তখন পুলিশের সোর্স সুজা দোকানের দ্বিতীয় তলায় উঠে চিৎকার করে বলেন, ‘স্যার পাইছি।’ পরে পুলিশ সদস্যরা স্বামীকে বলেন ওসি স্যার তাকে থানায় ডাকছে। থানায় গেলে টাকা আদায়সহ গাঁজা দিয়ে তাকে ফাঁসিয়ে দেয়। আলমগীর মুক্তি পেয়ে সেই অভিযোগ করায় তাকে মাদক ব্যবসায়ী সাজাতে পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তারের সময় এডিসি নিজ হাতে রানীর ভগ্নিপতি তাজুল ইসলামকে মারধর করেন। এর দুই ঘণ্টা পর এসে পুলিশ বাসা-দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ কেড়ে নেয়।
গত ৩ মে ডিএমপি কমিশনারের কাছে দেওয়া আলমগীরের অভিযোগে বলা হয়, ১৬ এপ্রিল ইফতারের আগে হাজত থেকে তাকে বের করে ২ লাখ টাকা দাবি করেন এসআই সেলিম ও আবুবকর। নয়তো গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল দিয়ে চালান করার হুমকি দেয়। আমি নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও কেন টাকা চাইছেন এমন প্রশ্ন করলে আরও বড় মামলার হুমকি দেন। এ অবস্থায় বাড়িতে খবর দিয়ে ৯০ হাজার টাকা নিয়ে এএসআই আবুবকরকে দিই। কিন্তু পরদিন আধা কেজি গাঁজাসহ আদালতে পাঠায় এবং বিষয়টি পরবর্তী সময়ে কাউকে জানালে ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
পুলিশের ডেমরা জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনারসহ (এডিসি) পুলিশ সদস্যদের হেরোইন মামলা নিয়ে জানতে চাইলে ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, আলমগীর হোসেনের পরিবার অভিযোগ করলে আইন অনুযায়ী তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্রঃ আমাদের সময়।