রাজধানীতে মুমূর্ষু রোগীর জন্য আইসিইউ শয্যা মিলছে না। এ অবস্থায় গুরুতর রোগীদের নিয়ে স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছেন। কেউ পাচ্ছেন আবার কেউ আইসিইউ শয্যা না পেয়ে সাধারণ শয্যায় কিংবা বাড়িতেই মারা যাচ্ছেন।
দেশে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড শনাক্ত ১৫ হাজার ১৯২ রোগীর মধ্যে ৬ হাজার ৪০ জন ঢাকা শহরের, যা মোট রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশ। শনাক্তের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাসপাতালগুলোতে চাপ বেড়েছে। সাধারণ শয্যা, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) শয্যা এবং অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়েও অনেক হাসপাতালে রোগী সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কর্মকর্তা জানান, সেখানে করোনা রোগীর চিকিৎসায় ২৩০টি সাধারণ শয্যা ও ২০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এখানে মাঝে মধ্যে সাধারণ শয্যা খালি পাওয়া গেলেও আইসিইউ খালি পাওয়া যায় না। কোনো রোগী সুস্থ হলে বা মারা গেলেই কেবল শয্যা খালি হয়। তবে খালি হলেও বাইরের মুমূর্ষু রোগীদের আইসিইউ শয্যা পাওয়ার সুযোগ কম। কারণ হাসপাতালের সাধারণ শয্যাতেও অনেক মুমূর্ষু রোগী রাখা হয়, যাদের আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। তাদের সাধারণ শয্যায় রেখে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে রাখা হয়। আইসিইউ খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ শয্যা থেকে তাদের কাউকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
জানা গেছে, শুধু বিএসএমএমইউ হাসপাতাল নয়, রাজধানীর অনেক হাসপাতালের চিত্র একই। ঢাকা শহরে করোনা রোগীর চিকিৎসায় সরকারি ১৬টি ও বেসরকারি ২৮টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ৯০০টি। এর মধ্যে সরকারিতে ৩৯৩ ও বেসরকারিতে ৫০৭টি। গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালগুলোর ৩৪৫টি শয্যায় রোগী ছিলেন, ১০টি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না। বাকি ৬টি হাসপাতালে ৪৮টি শয্যা খালি আছে। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ৯টিতে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল না। বাকি ১৯টিতে শয্যা ফাঁকা ছিল ৮৫টি।
এ ছাড়া ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা রয়েছে ৫ হাজার ৭১৭টি। এর মধ্যে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৮৯টি শয্যায় রোগী ছিল। কোনো কোনো হাসপাতালে সাধারণ শয্যার চেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসাধীন। হিসাব বলছে, সরকারি হাসপাতালের ৮৮ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী চিকিৎসাধীন। আর বেসরকারি হাসপাতালের ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশ আইসিইউয়ে রোগী রয়েছেন। সাধারণ শয্যার ৬৯ দশমিক ৭৯ শতাংশে রোগী রয়েছেন। সারাদেশে ১৩০টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১৫ হাজার ৭১৯টি সাধারণ শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ১০ হাজার ৪৩টি শয্যায় রোগী ছিল।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, করোনায় আক্রান্তদের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাসায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। বাকিদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ৪-৫ শতাংশ গুরুতর আক্রান্ত। তাদের অক্সিজেন সেচুরেশন দ্রুত কমতে থাকে, ফুসফুস খারাপ হতে থাকে। এদের আইসিইউর প্রয়োজন হয়। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় অক্সিজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব হাসপাতালে শয্যার তুলনায় বেশি রোগী, তাদের জন্য সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকে না। তাদের সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু যাদের অক্সিজেন বেশি লাগে, তাদের হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিতে হলে সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন থাকতে হবে। এ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক জটিল রোগী সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরসহ ৮ বিভাগের বিভিন্ন জেলায় করোনা রোগীর চিকিৎসায় ১৩০টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল চালু আছে। এর মধ্যে ১০২টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন রয়েছে। বাকিগুলো চলছে সিলিন্ডার অক্সিজেন দিয়ে। এসব হাসপাতালের ৬৬টিতে আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। বাকি হাসপাতালের অনেকগুলোয় আইসিইউ শয্যা খালি নেই। অনেক হাসপাতালে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে জেলাপর্যায়ে সংকট বেশি। ফলে সেখানকার রোগীরা উন্নত চিকিৎসা পেতে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ছুটছেন। অনেকে ঢাকায় ছুটে আসছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ২৪৭ জনের মধ্যে ১৬৫ জন সরকারি হাসপাতালে, ৫৫ জন বেসরকারিতে এবং ২৬ জন বাসায় মারা যান। এ ছাড়া একজনকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিদিন অনেক রোগী করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, করোনার রোগী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকার হাসপাতালের শয্যা বাড়াচ্ছে। সাধারণ শয্যা তাড়াতাড়ি বাড়ানো সম্ভব হলেও আইসিইউ শয্যা, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী তো দ্রুত বাড়ানো সম্ভব হবে না। এগুলো টেকনিক্যাল পদ হওয়ায় পড়াশোনা শেষ করার পর প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করতে হয়। কোনো কিছুর ঘাটতি থাকলে ঠিকভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে আমাদের সবার করোনা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। আমরা নিজেরা সচেতন হলে, মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব। অন্যথায় রোগীর চাপ বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে।