করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা নিতে এখন পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ২ কোটি ৪৯ লাখ মানুষ। এর মধ্যে অর্ধেকই টিকা পাননি। নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির পাশাপাশি বড় পরিসরে টিকা দিতে গত শনিবার থেকে ৬ দিনের গণটিকাদান ক্যাম্পেইন ঘোষণা করে সরকার। এ ক্যাম্পেইনের আওতায় দুই দিনে ৩৭ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রগুলোয় বরাদ্দের তুলনায় টিকা কম থাকায় অনেকেই টিকা পাননি।
নিয়মিত ও ক্যাম্পেইনসহ গত রবিবার বিকাল পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৪০ লাখ ৭ হাজার ৮৩৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত নিবন্ধন করেও টিকা পাননি ১ কোটি ৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৯০ জন। তবে বর্তমানে সরকারের কাছে যে পরিমাণ মজুদ আছে, তা দিয়ে নিবন্ধনকারী সবাইকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী ১৫ আগস্ট চীন থেকে ২০ লাখ ডোজ ও কোভ্যাক্স থেকে ৩৪ লাখ ডোজসহ মোট ৫৪ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, দেশে টিকাদান কর্মসূচি চালুর পর থেকে রবিবার বিকাল পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৭ হাজার ৮৩৭ জনকে, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৮.২৪ শতাংশ। এখন পর্যন্ত দুই ডোজ পেয়েছেন ৪৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯১ জন, যা মোট জনগোষ্ঠীর ২.৭০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে টিকা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৩ হাজার ৬২৮ ডোজ। সরকারের হাতে টিকার মজুদ আছে ৬৯ লাখ ২৭ হাজার ৫১২ ডোজ।
এর আগে স্বাস্থ্য বিভাগ বিশেষ টিকা ক্যাম্পেইন পরিচালনার মাধ্যমে ৭ থেকে ১৪ আগস্ট এক সপ্তাহে কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে ৭ আগস্টের আগে টিকার মজুদ ছিল ১ কোটি ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৪২৬ ডোজ। টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরুর আগে নতুন করে টিকাপ্রাপ্তির কোনো উৎস না থাকায় ক্যাম্পেইন পরিচালনার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে এবং নতুন পরিকল্পনা করে ৭ থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৩২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের ৪ হাজার ৬০০ ইউনিয়ন, পৌরসভার ১ হাজার ৫৪টি ওয়ার্ড ও সিটি করপোরেশনের ৪৩৩টি ওয়ার্ডে টিকাদানের কর্মসূচি ঘোষণা করে। যাদের জাতীয়পত্র আছে তাদের কার্ড নিয়ে কেন্দ্রে হাজির হলেই টিকা দেওয়া হবে- এমন ঘোষণা দেওয়া হয় স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে।
এরপর টিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিন ৭ আগস্ট স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে টিকাদান কেন্দ্রগুলোয় যে পরিমাণ টিকা পাঠানো হয়েছিল, সেখানে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা ছিল তার থেকে কয়েকগুণ বেশি। অনেককে টিকা নিতে ভোর রাত থেকে দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেক কেন্দ্রে ভিড়ের কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। টিকাগ্রহণকারীদের কেউ পেশিশক্তি, কেউ রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে টিকা নিয়েছেন। কেন্দ্রগুলোয় বরাদ্দ থেকে বেশি মানুষ উপস্থিত হওয়ায় অনেকে টিকা না পেয়ে ফিরে যান। টিকার তুলনায় বেশি মানুষ ভিড় করায় অনেক কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গণটিকাদান ক্যাম্পেইনের প্রথম দিন গত শনিবার মোট ৩০ লাখ ৭০ হাজার ২৬৮ জন, দ্বিতীয় দিনে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭২ জনকে টিকা দেওয়া হয়। আর গত ২৭ জানুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ১ কোটি ৪০ লাখ ৭ হাজার ৮৩৭ জন। আর ওই দিন বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন ২ কোটি ৪৯ হাজার ২৭ জন। এদের প্রত্যেককে দুই ডোজ করে টিকা দিতে সরকারের টিকার প্রয়োজন ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬২ হাজার ৫৪ ডোজ। সরকার এখন পর্যন্ত টিকা পেয়েছে ২ কোটি ৫৫ লাখ ২৭ হাজার ১৪০ ডোজ। নিবন্ধনকারী প্রত্যেককে দুই ডোজ করে টিকা দিতে হলে সরকারের আরও ২ কোটি ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ৯১৪ ডোজ টিকার প্রয়োজন, যা এ মুহূর্তে সরকারের কাছে নেই। তবে সরকার বিভিন্ন সোর্স থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে।
করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা সরকারের। সেই হিসাবে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে হবে। যদি সিঙ্গেল ডোজের জনসন ছাড়া অন্য টিকা প্রয়োগ করা হয়, তা হলে টিকার প্রয়োজন হবে ২৭ কোটি ২০ লাখ ডোজ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলছেন, সরকার বাজেটে টিকার জন্য ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। সরকারের টার্গেট ছিল প্রতিমাসে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার। এ হিসাবে টিকা দিলে সময় বেশি লাগত। এখন আমরা যে চিত্র দেখছি গত দুই দিনে টিকাদান ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ৩৭ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। আমরা যে গতি দেখছি তাতে বেশি সময় লাগবে না। এক মাসে নয়, একদিনেই ৩০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। যদি টিকার সাপ্লাই ঠিক থাকে, তা হলে এ বছরের মধ্যে অনেক মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা যাবে।
অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, সরকার বিভিন্ন সোর্স থেকে টিকা আনার চেষ্টা করছে। চীন থেকে ৬ কোটির বেশি টিকা আসবে। জনসনের ৭ কোটি টিকা পাওয়ার কথা। জনসনের টিকা যেহেতু সিঙ্গল ডোজ, এটি ৭ কোটি মানুষকে দেওয়া যাবে। গত দুদিনের চিত্র বলছে, দেশের মানুষের টিকা গ্রহণের আগ্রহ আছে। আমরা যদি টিকা পেয়ে যাই- টিকা দিতে বেশি সময় লাগবে না।
এর আগে সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ৩ কোটি টিকা ক্রয়ের চুক্তি করে। কিন্তু দেশটিতে সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করায় ৭০ লাখ ডোজ দেওয়ার পর আর কোনো টিকা পাঠায়নি ভারত। অর্থাৎ সেরামের কাছে এখনো সরকারের পাওনা ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ টিকা। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স থেকে দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে কোভ্যাক্স থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার ও মডার্নার টিকা পাওয়া গেছে। চীন থেকে সাড়ে ৭ কোটি টিকার ক্রয় চুক্তি করেছে সরকার। এর বাইরে রাশিয়া থেকে স্পুটনিক-ভি ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে জনসনের টিকা ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সূত্রঃ আমাদের সময়।