fbpx
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
বাড়িজাতীয়দেশের শিক্ষাক্রমে আসছে বড় ধরণের পরিবর্তন

দেশের শিক্ষাক্রমে আসছে বড় ধরণের পরিবর্তন

প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমই হবে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। আগে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ছিল ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ‘উদ্দেশ্যভিত্তিক’। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। বিদ্যমান পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণির পাবলিক সমাপনী পরীক্ষা- পিইসি ও জেএসসি বাতিল হবে। নবম শ্রেণিতে থাকবে না সায়েন্স, আর্টস, কমার্স নামে বিভাগ বিভাজন। দশম শ্রেণির পাঠ্যবিষয়ের ওপরই হবে এসএসসি পরীক্ষা। এইচএসসির মূল্যায়ন হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুই পরীক্ষায়। সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষাধারার অষ্টম শ্রেণি থেকে ‘কর্মমুখী’ শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ থাকছে নতুন কারিকুলামে। দক্ষতা তৈরির জন্য নতুন বিষয় ‘জীবন ও জীবিকা’ যুক্ত হবে পাঠ্যপুস্তকে। পুরো কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে কমে যাবে পরীক্ষা, বদলে যাবে পাঠ্যবই। আগামী বছর পাইলটিং হবে নির্বাচিত বিদ্যালয়ে।

২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হবে এই নতুন কারিকুলাম। ওই বছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন বই। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম, নবম, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণি এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে পরের বছর হবে নতুন বই।

গতকাল শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন শিক্ষাক্রম অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকবে না, নতুন কারিকুলামে সেটা চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলামে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) ও অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে হবে না। স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হবে এই পরীক্ষা। সার্টিফিকেটও দেওয়া হবে।

মন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আসছে। নবম ও দশম শ্রেণিতে মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা নামের বিভাগ তুলে দেওয়া হচ্ছে। একটি সমন্বিত পাঠ্যক্রম থাকবে এই পর্যায়ে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি বিষয় ঠিক করা হয়েছে, এগুলো সবাই পড়বে। এতদিন নবম ও দশম শ্রেণির কারিকুলাম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা হতো। পরিমার্জিত কারিকুলামে শুধু দশম শ্রেণিতে যা পড়ানো হবে, তার ওপর ভিত্তি করে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো পড়বে শিক্ষার্থীরা। অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্যে বিভাজন হবে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে।

এইচএসসির চূড়ান্ত পরীক্ষার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি শিক্ষাবর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কারিগরিতে এখন তা-ই হচ্ছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুটো পরীক্ষার সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফল নির্ধারিত হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দক্ষতা অর্জনের বিভিন্ন কৌশল এই পরিমার্জিত কারিকুলামে বলা আছে। শিখন সময় প্রাথমিকে কতটা, মাধ্যমিকে কতটা হবে তা বলা আছে। আমরা সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। কোথায়, কোন কোন পর্যায়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে সেগুলো আমরা ভাগ করেছি। কোন কোন বিষয় টোটালি ধারাবাহিক মূল্যায়নে যাবে সেগুলো বলা আছে রূপরেখায়। শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্তিমূলক যে বিষয়টি এনেছি, সেখানে ফ্লেক্সিবিলিটি নিয়ে আসা হয়েছে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী বা সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সবাইকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, বিদ্যমান শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম উদ্দেশ্যভিত্তিক। এর ফলে শিক্ষাক্রম রূপরেখায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এক স্তর থেকে আরেক স্তরে উন্নীত হলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় খাপখাওয়াতে সমস্যা হয়। এতে মাধ্যমিকে গিয়ে ঝরে পড়ে অনেকে। নতুন কারিকুলামে প্রাথমিকের সঙ্গে সেতুবন্ধ হবে মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়ায়।

প্রাথমিক স্তরের নতুন পাঠ্যক্রম প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন আমাদের সময়কে জানান, বিদ্যমান কারিকুলামে একটি সমস্যা হচ্ছে-প্রাথমিকের শিশুরা যখন মাধ্যমিকে যায়, তাদের পাঠ্যক্রমও ভিন্ন হয়। এবার যখন আমরা নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে ভাবছি তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দুই স্তরের পাঠ্যক্রমে একটি সেতুবন্ধ থাকতে হবে। সেভাবে পাঠ্যক্রম প্রণয়নে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, আগের পাঠ্যক্রমটি ছিল প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পাঠ্যপুস্তককেন্দ্রিক এবং মুখস্তনির্ভর। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম শ্রেণিকক্ষে যথাযথ বাস্তবায়নের অভাব ছিল। গুরুত্ব অনুসারে বিভিন্ন বিষয়ে সময়ের বণ্টন যথাযথ নয়। আবার শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতাসমূহতে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সুষম প্রতিফলন যথাযথ ছিল না। প্রচলিত শিক্ষাক্রম পরিবর্তিত বৈশ্বিক চাহিদা, রূপকল্প ২০৪১, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার সাথে প্রাসঙ্গিক রেখে নতুন কারিকুলাম করা হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে বই এবং পরীক্ষা পদ্ধতি বদলে যাবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির সদস্য (মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, শিখন কৌশলেও নানা পরিবর্তন আসবে। এখন যেভাবে মুখস্থবিদ্যা চলছে, নতুন শিক্ষাক্রমে সেটি একেবারেই অনুপস্থিত থাকবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষাক্রম আসছে তা আয়ত্তে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক মেধার প্রয়োগ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। কিন্তু প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকরা শেখাবেন। প্রাথমিকের জন্য আটটি বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এর মধ্যে ‘ভালো থাকা’ এবং ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে আলাদা বই থাকবে না। এসব শিক্ষকরা শেখাবেন, এ জন্য নির্দেশনামূলক বই দেওয়া হবে। আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বই পড়ানো হবে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
যে পদ্ধতিতে হবে পরীক্ষা

দশম শ্রেণির ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টিতে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান) সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ ও শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশসহ উভয়ের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হবে। অবশিষ্ট ৫টি থিমভিত্তিক বিষয়ে বিদ্যালয়ে শিখনকালীনই ১০০ শতাংশ মূল্যায়ন করা হবে। ৯ম-১০ম শ্রেণির মূল্যায়ন হবে ৫০ নম্বর শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ নম্বরের। ৪র্থ-৫ম ও ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ নম্বরের এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ নম্বরের। ১ম-৩য় শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ নম্বরের। কোনো পরীক্ষা হবে না। অনুরূপ প্রাক-প্রাথমিকেও ১০০ নম্বরের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন বা পরীক্ষা হবে ৭০ শতাংশ। প্রায়োগিক বা ঐচ্ছিক বিষয় শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। এছাড়া নৈর্বাচনিক, বিশেষায়িত কাঠামো, প্রকল্পভিত্তিক, ধারণানুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক ও ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।
চলতি বছর থেকেই পর্যায়ক্রমে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরুর সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এজন্য প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০১২ সালে। এর আগে ১৯৯৫ ও ১৯৭৬ সালে আরও দুবার শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

Recent Comments