সচেতন বার্তা, ৮ জুলাই:গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক সাংসদ। অধিবেশন চলাকালে সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়া দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বৈধ হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে সংসদে।
গত রোববার জাতীয় সংসদের বৈঠকে সম্পূরক প্রশ্ন ও অনির্ধারিত আলোচনায় তিনজন সাংসদ গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় প্রত্যক্ষভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে পরোক্ষভাবে বিষয়টি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
রাশেদ খান মেনন বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে গৃহস্থালি, শিল্প, পরিবহন অর্থাৎ অর্থনীতির সামগ্রিক ক্ষেত্রে এর একটা প্রতিক্রিয়া হবেই। জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া আছে। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা আছে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর সমালোচনা করে মেনন বলেন, ‘আমি নিজেও হতাশ। এই কারণে যে, বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর সাফল্যের প্রশংসা করে আমি বলেছিলাম, মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে অন্তত সংসদে আলোচনা করুন, যাতে সকল সংসদ সদস্য অংশগ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু মাননীয় স্পিকার, আমরা দেখলাম বাজেট অনুমোদেনর চার ঘণ্টার মাথায় বিইআরসি ঘোষণা দিয়ে দিল। এটা সংসদের প্রতি চরম অবমাননা, সংসদকে এড়িয়ে যাওয়া। আপনি স্পিকার, আপনি সংসদের অভিভাবক, আপনি বিষয়টিকে নিশ্চয় সেভাবে দেখবেন।’
মেনন বলেন, ‘খোলামেলা আলোচনা করে সিদ্ধন্ত নিক। সিদ্ধান্ত সরকার নেবে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জনগণের কথা শোনর দায়িত্ব সরকারের। সংসদের কথা মানার দায়িত্ব সরকারের। শুধু তা–ই নয়, বিইআরসি গণশুনানি করেছিল। তা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। সেই মামলার বাইরে গিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং সেটাও অবৈধ, বেআইনি এবং কোর্টকে অবমাননা। তারা সংসদকে অবমানা করছে, কোর্টকে অবমাননা করছে এবং সর্বোপরি জনগণকে অবমানা করছে।’
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা হরতালের বিষয়ে মেনন বলেন, হরতাল হয়েছে কি হয়নি, কতটুকু হয়েছে বা আগের দিনের চেয়ে যানজট বেশি ছিল— এসব কূটতর্ক করে লাভ নেই। বিষয়টির গভীরতা অনুভব করে আলোচনা করা উচিত।
মেনন বলেন, মন্ত্রী বলেছেন মূল্য সমন্বয় এবং ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। ভারত এক হাজার সিএফটি এলএনজি আনছে সাড়ে ৬ ডলার দিয়ে। বাংলাদেশ আনছে সাড়ে ১০ ডলার দিয়ে। পাকিস্তানে আনা হচ্ছে সাড়ে ৯ ডলার দিয়ে। বলা হচ্ছে গ্যাস শহরের মানুষ ব্যবহার করে। কিন্তু গ্রামের মানুষ এলপিজি ব্যবহার করে। ইতিমধ্যে এলপিজির মূল্য ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এই মূল্য সমন্বয়ের ফলে এলপিজির দাম বেড়ে গেছে। যখন সিএনজি বন্ধ করে দেওয়া হবে তখন সিএনজি স্টেশনগুলো এলপিজিতে রূপান্তরিত হবে। আসলে এলপিজির বাজার ঠিক করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না, সেটাও আলোচনার বিষয়। তিনি এ বিষয়টি সংসদকে অবহিত করার জন্য বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে বলার জন্য স্পিকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
মেনন বলেন, গ্যাসের দাম নিয়ে সংসদে আলোচনার জন্য তিনি ৬৮ বিধিতে একটি নোটিশ দিয়েছেন। হাসানুল হক ইনু, মইনুদ্দিন খান বাদল, ফজলে হোসেন বাদশা, মোস্তফা লুৎফুল্লাহ এবং লুৎফননেসা খান তাঁর নোটিশে সমর্থন করেছেন।
মেনন বলেন, ‘আমি আশা করব সংসদের অধিকার রক্ষার্থে, সংসদ সদস্যদের কথা বলার জন্য আপনি নিশ্চয় ওই নোটিশ আলোচনার জন্য দেবেন।’
মেননের বক্তব্যের পর স্পিকারের চেয়ারে থাকা ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ৬৮ বিধিতে দেওয়া নোটিশটির বিষয়ে স্পিকার সিদ্ধান্ত দেবেন।
এর আগে সম্পূরক প্রশ্নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের আরেক শরিক জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, মাত্র বাজেট শেষ হলো। অনেক ক্ষেত্রে অনেক প্রশংসা, আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, বাজেট পাসের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের দাম বেড়ে গেল। সিএনজিসহ গৃহস্থালির গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ল, তার একটা প্রভাব পড়ছে। আবার এলএনজি আমদানিতে দাম ভারতের চেয়ে বেশি পড়ছে।
শিরীন বলেন, ‘এ রকম একটি বাজেট দেওয়ার পরে যে জায়গায় আমরা একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলব ভাবছিলাম, সেই জায়গায় এই অবস্থা তৈরি হওয়ার পেছনে কারণটা কী, তা আমি জানতে চাই।’
জবাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের অনুপস্থিতে তাঁর পক্ষে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় প্রত্যক্ষভাবে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে পরোক্ষভাবে বিষয়টি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে পরোক্ষভাবে আমরা লাভবান হব। কারণ আজকাল গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে ফিরে যায় না। তারা চাকরি করতে চায়। তাদের চাকরির জন্য শিল্পকারখানা গড়া দরকার। সে জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দরকার আছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়লে অর্থনীতিতে তার বহুমুখী প্রভাব কেমন হবে, তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সার্বিক বিবেচনায় অর্থনীতির জন্য এটি ইতিবাচক।’
সম্পূরক প্রশ্নে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম জানতে জানতে চান, সংসদ চলাকালে সংসদকে না জানিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো বৈধ হয়েছে কি না? একই সঙ্গে তিনি জানতে চান, বিদ্যুৎ ব্যবহারে ই–টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মন্ত্রী নিজেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। এটা করে কী লাভ হলো?
জবাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, টিআইএন বিষয়ে তাঁর বিস্তারিত জানা নেই। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য নোটিশ দিলে সঠিক উত্তর পাবেন। আর গ্যাসের বিষয়ে তিনি আগেই বলেছেন।
বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা জানতে চান, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হচ্ছে কেন?
জবাবে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতা ছাড়ে তখন বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৩ হাজার ২০০ মগাওয়াট। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা ১ ওয়াট বিদ্যুৎও যোগ করতে পারেনি। এখন ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। শিল্পকারখানা সচল ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে। সুতরাং রাজনীতি না করে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে।