দিনের হিসেবে ২৮ সেপ্টেম্বর বাঙালির জীবনে বিশেষ তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য সম্পন্ন। কারণ এই দিন বাঙালির গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পাখি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিন। তার জন্মের আবাহন বাঙালির জন্য বিশেষ প্রেরণার এবং সর্বময় শক্তির।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর জনগণের আশা-আকাঙ্খার যত বাস্তবায়ন তা তার একক নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। স্বীকৃতি হিসেবে পালকে যুক্ত হয়েছে গণতন্ত্রের মানসকন্যার উপমা। এই উপমা যুক্ত হওয়ার কারণ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে ষড়যন্ত্র, হত্যাঝুঁকি এবং স্বৈরতন্ত্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দেশে ফিরেছেন। জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার রক্ষায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন, চষে বেড়িয়েছেন। গণতন্ত্রের সেই ধারাবাহিক স্রোতের ফলই আজকের উন্নয়ন- অগ্রযাত্রার কারণ।
সাম্প্রতিককালে এর উদাহরণ হলো, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে বিশ্বের বৃহৎ ও প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক শক্তিগুলো ম্রিয়মাণ সেখানেও বাংলাদেশ উজ্জ্বল, দীপ্ত পথযাত্রায় নান্দনিক ভাস্কর। বিশ্ব অর্থনীতিতে এগিয়ে চলা পাঁচটি দেশের মাঝে একটি। বর্তমান অবস্থানে যা বিশ্বের ৪১তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। শুধু তা-ই নয়, মাথাপিছু আয়ও উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। ১২ বছর পূর্বে যেখানে দেশে মাথাপিছু আয় ছিল ৫০০ থেকে ৭০০-এর ঘরে সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২২৭ ডলার।
এর মাঝে আরেক বড় অর্জন হলো, দেশের রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া। যার ওপর ভর করে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ এখন এগিয়ে চলছে আরও দুর্বারগতিতে। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতেও দৃশ্যমান হয়েছে উন্নয়ন। যেমন- শিশু-মাতৃ মৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে, নারী-পুরুষের গড় আয়ু বেড়েছে, শতভাগ স্যানিটেশন ব্যবস্থায় সাফল্য এসেছে। এতে স্বীকৃতিস্বরূপ মিলেছে বৈশ্বিক এবং আন্তর্জাতিক সাধুবাদ। এসবই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্ব পরাশক্তিধর দেশগুলোকেও পেছনে ফেলে জাতীয় অর্জনের নতুন নতুন রেকর্ড।
এ ছাড়া ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো দেশের দুর্দশায় বাংলাদেশ ঋণ সুবিধা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো নজির সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকাকে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধার আওতায় এনেছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগে যারা আমাদের পেছনে ফেলে রাখতে চেয়েছিল তাদের সকল জারিজুরি মিথ্যা প্রমাণ করে নিজস্ব অর্থায়নে বাঙালির আবেগ-স্পর্ধা পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে। বাঙালিকে কলঙ্ক এঁকে দেওয়ার সকল ষড়যন্ত্রকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
খাদ্য ঘাটতিতে সব সময় বুঁদ হয়ে থাকা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে রপ্তানিমুখী টানেলে নিয়ে গেছে। আগামীর বিশ্ব অংশীদার ও নেতৃত্বের দাবিদার হিসেবে পৃথিবীর ৫৭তম দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণসহ বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সফল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গা সংকটের মতো মানবিক সংকট মোকাবিলায়ও এখন পর্যন্ত মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। যদিও এও সত্য দিনে দিনে একে কেন্দ্র করে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাইরের সুযোগসন্ধানী চক্র ভীষণ তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে আত্মবিশ্বাসের বিষয় হলো, একে মোকাবিলা করতে বিদীর্ণ বাংলার আলোক সারথি শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর এবং কৌশলী পদক্ষেপে প্রস্তুত।
যদিও বাস্তবতা হলো, পিতার মতো তার পথচলাটাও চরম বন্ধুর ও সংকটসম্পন্ন। কারণ ইতিমধ্যে তাকে প্রায় ১৯ বার হত্যাচেষ্টা করা হয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে ব্যবহার করা হয় এমন আর্চেস গ্রেনেড দিয়েও তাকে সরাসরি হামলার শিকার হতে দেখা গেছে। আর এই বিষয়টি ঘটিয়েছিল ২০০৪ সালে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি-জামায়াত জোট। যা বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে এখন পর্যন্ত ঘটানো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নারকীয় ও বীভৎস বর্বরতা।
এই বিষয়গুলো যে বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা, নেতৃত্বে ঘটানো তার প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে তৎকালীন বোম নিষ্ক্রিয়কারী দলের ক্যাপ্টেন সামসুদ্দিন আহমদ সামসের মতো ব্যক্তিদের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। হামলার আলামত সংগ্রহ করতে গিয়ে এই সমস্ত ব্যক্তিবর্গের বিনা নোটিশে বদলি এবং কিছুদিনের ভেতরেই চাকরিচ্যুত হতে হয়েছিল। এমন লাগামহীন আক্রান্তের খবরাখবর, ভয়ভীতির অগণিত সাক্ষ্য এবং প্রমাণ আছে সময়ের দেয়াল-জমিনজুড়ে।
তবে এসব ষড়যন্ত্র হটিয়ে সবচেয়ে সাহসের বিষয় হলো, শেখ হাসিনা তার লড়াই জারি রেখেছেন। দেশকে এশিয়ার অর্থনৈতিক অঞ্চল বা সীমানা থেকে বৈশ্বিক করিডরে নিয়ে গেছেন। যেখানে বিশ্বও অবাক, তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা হটিয়ে বাংলাদেশ এখন উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। ফল একদা যারা তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা জুড়ে দিয়েছিল আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদেরও বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতায় হাত বাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, সেই দেশই এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে।
সব ছাপিয়ে শেখ হাসিনা তার তরুণ প্রজন্মের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছেন এবং হয়ে থাকবেন। এক. দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির গৌরব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সঠিকভাবে তুলে ধরবার ও সংরক্ষণের কারণে এবং দুই. ঘুষ-দুর্নীতির বাইরেও যে মেধা-মনন দিয়ে চাকরি হয় সেটা প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিত করবার জন্য। যা অন্য যে কোনো সময় ছিল অকল্পনীয়। শোনা যায়, বিএনপি-জামায়াতের সময় সরকারি চাকরির জন্য গোপন নিলামও চলেছিল।
পরিণত বয়স সব সময় সুন্দর এবং সাফল্যের। প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এখন সেই সময়টাই পার করছেন। কাজেই তার জন্য বিশেষ প্রার্থনা এই যে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলা বয়স ঘড়িকে নিজের মানসিক তারুণ্য দিয়ে তিনি শতায়ু হবেন। জন্মের সার্থকতায় আরও উন্নয়ন, অর্জন এবং মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপনে ইতিহাস করে যাবেন। সৃষ্টিকর্তা তার সহায় হোক।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।