যশোরের বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে গত ৯ মাসে ভারত থেকে ফিরেছেন ৯২ জন নারী। যার মধ্যে কিশোরী ৪৯ জন। বাকি ৪৩ জন তরুণী। এই সংখ্যা প্রমাণ করে যে ভারতে পাচারকারীদের লক্ষ্য বাংলাদেশি কিশোরী।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্র জানায়, গত ১ জানুয়ারি ভারত থেকে ফেরত আসেন পাচারের শিকার তিন তরুণী। ২৫ জানুয়ারি আসেন ২৮ জন। এর মধ্যে ১৮ জনই কিশোরী। গত ৩০ জানুয়ারি তিনজন নারী। এর মধ্যে কিশোরী একজন। ৯ মার্চ আসেন এক তরুণী। ১৯ মার্চ আসেন আট নারী। এর মধ্যে কিশোরী চারজন। গত ৬ জুন আসে এক কিশোরী। ১৩ জুন আসে তিনজন। এর মধ্যে কিশোরী একজন। ২১ জুন আসে এক কিশোরী। ১৩ জুলাই আসে এক কিশোরী। গত ২০ জুলাই আসেন দুই তরুণী। ২৯ জুলাই আসেন তিন নারী। এর মধ্যে কিশোরী একজন। গত ২ সেপ্টেম্বর আসেন সাত তরুণী। ৭ সেপ্টেম্বর আসেন এক তরুণী। ২০ সেপ্টেম্বর আসেন ১৬ নারী। এর মধ্যে কিশোরী ১২ জন। ২৩ সেপ্টেম্বর আসেন দুই তরুণী। ৩০ সেপ্টেম্বর আসেন ১২ তরুণী। এ ছাড়া গত ৭ অক্টোবর দেশে ফিরেছেন সাত কিশোরী ও চার তরুণী। এসব নারী কোন পথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৮টি সীমান্ত পথ দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার নারী ভারতে পাচার হচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, যশোরের শার্শা ও বেনাপোলের পুটখালী, দৌলতপুর, সাদিপুর, রঘুনাথপুর, কায়বা, রুদ্রপুর, গোগা, অগ্রভুলোট সীমান্ত দিয়ে নারীপাচার হয়। ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগণার গাইঘাটার আঙরাইল, বনগাঁর কালিয়ানী পিরোজপুর, বাগদার বয়রা, রানাঘাট সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে ঢোকানো হয় এই মেয়েদের। তারপর দালালরা তাঁদের নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে তাঁরা যান মুম্বাই, পুনে, দিল্লিসহ ভারতের বড় শহরগুলোতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌনপল্লী ও বারে নাচের কাজ জোটে তাঁদের।
গত ২০ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে ফেরত আসা পিরোজপুরের এক তরুণী জানান, তিন বছর জেল খেটে দেশে ফিরেছেন। দালালদের খপ্পরে পড়ে ভালো চাকরির আশায় মুম্বাই গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে একটি ঘরে আটকে যৌন নির্যাতন চালানো হয়। এক সপ্তাহের বেশি কোথাও রাখা হয় না। মুম্বাই থেকে পুনে নেওয়ার পথে তিনি কৌশলে পালিয়ে যান। পুলিশ তাঁকে আটক করে।
পাচারের শিকার আরেক নারী জানান, সাতক্ষীরার এক পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে ২০১৯ সালে মার্চে স্বামীর সঙ্গে মুম্বাই যান। কলকাতার এক দালাল ট্রেনে করে তাঁদের মুম্বাই নেয়। তিন দিন পর অনুপ্রবেশের অপরাধ দেখিয়ে স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় দালালরা। পরে রাতে দালালরা তাঁকে পুনের বুধওয়ার পেথ নামক একটি যৌন পল্লীতে বেচে দেয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি এক রাতে পালিয়ে নিকটস্থ থানায় আশ্রয় নেন। পুলিশ আদালতে পাঠালে তাঁকে দোষী করে আড়াই বছরের সাজা দেয়। সাজাভোগ শেষে দেশে ফেরার কাগজ তৈরি করতে লাগে প্রায় ৮০ দিন। এরপর স্বামীকে নিয়ে দেশে ফেরেন।
বেসরকারি সংস্থা জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের যশোরের জেষ্ঠ কর্মসূচি কর্মকর্তা এ বি এম মুহিত হোসেন জানান, বাংলাদেশ থেকে নারীপাচারের ইতিহাস অনেক দিনের হলেও এটি বন্ধের জন্য খুব বেশি সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে একমাত্র উদ্যোগ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা। এটি যে শুধু আইন দিয়ে বন্ধ হবে, তা কিন্তু না। দুর্বলতাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। কিভাবে এই পাচার ঘটে এবং সেই হিসেবে প্রতিরোধের উপায়গুলোও হাজির করতে হবে। এ ছাড়া পাচারকারীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে। সেই কৌশলগুলোর বিপরীত কৌশলও ঠিক করতে হবে।
যশোরের মানবাধিকার সংস্থা রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন হোমে বাংলাদেশি শতাধিক তরুণী দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন। আমরা দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানিয়েছি। আটকদের নাম-ঠিকানা পরীক্ষা করা হচ্ছে। খুব দ্রুত বিষয়টি সমাধান করে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেগম সালমা আলী বলেন, ‘গত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া দুই হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।’
বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি মামুন খান বলেন, ‘আমরা মানবপাচার রোধে বিভিন্ন সীমান্ত এলা কায় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় লোকজন নিয়ে সভা করেছি। তার পরও তা রোধ করা যাচ্ছে না।’ সূত্রঃ কালের কন্ঠ।