জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে এলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে, সরকারের এমন ঘোষণার মধ্যেই রিট আবেদন দায়ের এর ঘটনা ঘটলো।
সোমবার হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাসের পক্ষে রিটটি করেন আইনজীবী মো. আসফাকোজ্জোহা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দায়-ব্যর্থতা, প্রেক্ষাপট-পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্রকারী, সুবিধাভোগীদের নির্ণয় করতে এ কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৪৬তম বার্ষিকী সামনে রেখে গত ১২ অগাস্ট ঢাকায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে।
মন্ত্রী বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুর খুনি যাদের সাজা হয়েছে, কেবল তারা এককভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তা নয়, এর পেছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে। ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে তাদের নাম জনসম্মুখে প্রকাশের সিদ্ধান্ত সরকার ইতোমধ্যে নিয়েছে। এই কমিশনের রূপরেখা কী হবে? এই কমিশনের কার্যাবলি কী হবে এবং কমিশনটা কাদের দ্বারা গঠিত হবে। এই জিনিসগুলি করোনাভাইরাসের প্রকোপটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনারা দেখতে পাবেন।”
সরকারের এমন প্রতিশ্রুতির মধ্যে রিট আবেদনের কারণ জানতে চাইলে আইনজীবী সুবীর নন্দী জানান, এক মাস আগে মন্ত্রপরিষদ সচিব, আইন সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু কোনো দপ্তর থেকে কোনো জবাব পাননি। এমনকি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপও তিনি দেখেননি।
কমিশন গঠনের বিষয়ে এই আইনজীবী বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের একবার বিচার হয়েছে। মামলাটি হয়েছিল হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পরে। এই ২১ বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল এমন অনেকেই বিচারের আগেই মারা গেছেন। মৃত্যু হলে তো কাউকে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আনা সম্ভব না। ফলে মৃত্যুর কারণে অনেক অপরাধীই এ অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। ফলে তাদের চিহ্নিত করে দেশ-জাতির কাছে তা তুলে ধরা দরকার।
“হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুকে কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের কারা কীভাবে হত্যা করেছে তার বিচারটা হয়েছে। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের যারা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, পরিকল্পনা করেছে, ষড়যন্ত্র করেছে এবং হত্যাকাণ্ডের পর কারা সুবিধাভোগী হয়েছে, কাদের কী দায় ও ব্যর্থতা ছিল সেটি নির্ণয় করার সুযোগ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় নাই।”
এসব কারণে রিট আবেদনে একটি স্বাধীন জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও অর্থ সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে রিটে।
এতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যুক্তরাজ্যে গঠিত একটি তদন্ত কমিশনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড তদন্তে কমিশন গঠনের উদাহরণ তুলে ধরা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ১৯৮১ সালে যুক্তরাজ্যে একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তবে এ কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হয়নি।
তখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
পরে ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাজ্যের এই কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আইনি ও বিচার প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব পথে এগোতে দেওয়া হয়নি। আর এজন্য সরকারই দায়ী।
বিচার পাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান রেখেছিল স্বাধীন এই অনুসন্ধান কমিশন, যদিও তাতে কান দেওয়া হয়নি।
১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যার ঘটনার মিশন গঠন করা হয়েছিল জানিয়ে সুবীর নন্দী বলেন, “মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ড তদন্তে ১৯৬৬ সালে কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
এছাড়া ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড তদন্তে ৪টি কমিশন, ৯টি কমিটি ও দুইটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। সুভাস চন্দ্র বসুর অন্তর্ধান নিয়েও বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল।
আইনজীবী সুবীর জানান, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালেই হামাদুর রহমান কমিশন গঠন করা হয়েছিল। রিটে এসব কমিশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
একদল সেনা কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম তখন ধানমণ্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত, তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর আসে।
বাকি ১১ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন বন্দি অবস্থায় আদালতে রিভিউ আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায়।
এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। বাকি ছয়জন পলাতক থেকে যান।
এর প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক ছয়জনের একজন ৭২ বছর বয়সী মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় সরকার।
পলাতক মাজেদের আপিলের সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন, যা নাকচ হয়ে যাওয়ার পর কেরানীগঞ্জের কারাগারে ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর হয়।