দুর্নীতির মাধ্যমে ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির ৬৩৮ কোটি টাকা লোপাট করেছে সাবেক চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমানসহ পরিচালনা পর্ষদ। নানা কৌশলে নিয়মবহির্ভূতভাবে এই টাকা তুলে নেওয়া হয়। এরমধ্যে রয়েছে ভুয়া বিলের মাধ্যমে আইনি খরচ, ভবন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং ঢাকা-চটগ্রামের বিভিন্ন হোটেলের খাবারের নামে টাকা উত্তোলন। এছাড়া মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে কর পরিশোধের নামে। পাশাপাশি সফটওয়্যার কেনা, কোম্পানির অর্থে কেনা শেয়ার লেনদেনে কারসাজি এবং ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ ভ্রমণেও এ অর্থ ব্যয় করা হয়।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
আইডিআরএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোম্পানির ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল নিরীক্ষায় ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির ৬৩৮ কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম উদ্ঘাটন হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, কোম্পানির বরখাস্তকৃত পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উল্লিখিত অনিয়ম করা হয়।
ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় ১১ মাস আগে কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদকে বরখাস্ত করে আইডিআরএ। এরপর প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে যাবতীয় কার্যক্রম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ২৮ অক্টোবর নিজ কার্যালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, বিমা খাত আগের তুলনায় অনেকটা এগিয়েছে। বর্তমানে একে ভিত্তির মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। এক সময় লাইফ বিমা করার পর মেয়াদ শেষে অনেকে টাকা ফেরত পেতেন না। এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটেছে। আবার সাধারণ বিমায় নিজেরা কারখানায় আগুন দিয়ে বিমার টাকা দাবি করতেন। এগুলো এখন বন্ধ হয়েছে। বিমা খাতের বহু এলাকা ঠিক করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্সের বিষয়টি দেখা হবে।
ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির দুর্নীতির প্রতিবেদনটি আইডিআরএর পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেছেন পরিচালক মো. শাহ আলম। এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কিনা-জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রথমে এ প্রতিষ্ঠানে একজন প্রশাসক বসানো হয়েছে। এরপর প্রশাসককে তাদের বিগত সময়ের কার্যক্রমের ওপর নিরীক্ষা করতে বলা হয়। বর্তমান প্রশাসক নিরীক্ষা রিপোর্ট করে আমাদের কাছে দাখিল করেছে। অডিট রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী এখন সরকার ব্যবস্থা নেবে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বিশেষ করে মানি লন্ডারিং করা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ জন্য রিপোর্টটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে পাঠাবে।
যেসব খাতে দুর্নীতি : আইডিআরএর প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির সিইও-এর মৌখিক নির্দেশে কর অফিসের খরচের জন্য ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। আবার ভুয়া আইনি খরচ দেখিয়ে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে ৯২ লাখ টাকা তোলা হয়। পরে কর অফিস ও আইনি খরচের সব টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এছাড়া কোম্পানির নিজস্ব ভবন ডেলটা টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রায় ৩১ লাখ টাকার একটি ভুয়া বিল তৈরি করা হয়। পরে সেই বিলের বিপরীতে তুলে নেওয়া হয় অর্থ। কোম্পানির খুলনা, বগুড়া ও রাজধানীর গুলশানে ডক্টরস ও ডিএলআই টাওয়ারের ফ্লোর ভাড়ার নামে কৌশলে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
দুর্নীতির ফিরিস্তিতে আরও দেখা গেছে, চটগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে প্রায় ৩৮ লাখ টাকার খাবারের ভুয়া বিল বানানো হয়। ওই বিলের অনুকূলে কোম্পানির হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সেখানে কোনো খাবার পরিবেশন করা হয়নি। এ প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান, জেইভিপি মো. আবদুল আউয়াল (আইডি নং-০৪৪৭৬), এসভিপি মো. নৃপেন্দ্র পোদ্দার (আইডি নং-০৪৪৭৫) বেতন নিয়েছেন পৌনে ৩ কোটি টাকার বেশি। এসব কর্মকর্তা বেতন নিয়েছেন ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে। কিন্তু অফিসে সময় না দিয়ে মাসের পর মাস কাজ করেছেন নিজেদের গড়ে তোলা অফিসে। রেমা টি নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের বেতন নিলেও কাজ করতেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া ভুয়া বিমার পলিসি তৈরি করে প্রথমে ২ লাখ টাকা পরে ১১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাবেক পরিচালক মো. সাইদুর রহমান। তদন্ত কমিটি দেখতে পায়-মোটা অঙ্কের এই টাকা খরচের আই.ও.ইউ’র মূল কপি কোম্পানির হিসাব বিভাগে পাওয়া যায়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয় পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিমা দাবির পরিমাণ কম দেখানো হয়েছে। এ কৌশল অবলম্বন করে অতিরিক্ত ২৮ কোটি টাকা বেশি মুনাফা দেখানো হয়। একইভাবে প্রায় ১৫ কোটি টাকার বকেয়া পুনঃবিমা দাবির দায় থাকা সত্ত্বেও তা হিসাবভুক্ত করা হয়নি। আর্থিক হিসাবের এ কারচুপির মাধ্যমে কোম্পানির ৪৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) দেখিয়ে মুনাফা দেখানো হয়েছে। ওই মুনাফা থেকে লভ্যাংশের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। যা প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি বটে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।
আইডিআরএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ সফর গিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক ও সিইওসহ অন্য কর্মকর্তারা ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। পাশাপাশি গাড়ি ব্যবহারের নামে সাড়ে ৫ কোটি টাকা নিয়মবহির্ভূত আর্থিক ক্ষতি করা হয়। করোনাকালীন শুধুু জুম মিটিংয়ের নামে প্রায় ৫ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ না দিয়েও একাধিক খাতে বরাদ্দ প্রায় আড়াই লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া দরপত্রের যথাযথ প্রক্রিয়া ও শর্ত অনুসরণ না করেই বিদেশি কোম্পানি হানসা সলিউশনস থেকে ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের আই-ওয়ান সফটওয়্যার কেনা হয়। একইভাবে প্রায় ৭৮ লাখ টাকা মূল্যের ভি এমওয়্যার ভিএসপেয়ার সফটওয়্যার কেনা হয়। এক্ষেত্রে তথ্যের গরমিল ও কেনায় অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির হিসাব থেকে প্রায় ১৯ কোটি টাকা দিয়ে পুঁজি বাজার থেকে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশের শেয়ার কেনা হয়। পরে ওই শেয়ার লেনদেনে টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আইনত কোম্পানিতে একই পরিবারের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করা আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু দেখা গেছে, সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের পরিবারের শেয়ারের পরিমাণ ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে মঞ্জুরুর রহমান (মিসেস আদিবা রহমান গংদের পিতা) ধারণকৃত শেয়ার ২ দশমিক ৮২ শতাংশ, মিসেস সুরাইয়া রহমান ( মঞ্জুরুর রহমানের স্ত্রী) ধারণকৃত শেয়ার ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ, জিয়াদ রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের পুত্র) ধারণকৃত শেয়ার ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, আনিকা রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে) ধারণকৃত শেয়ার ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ, মিস শাইকা রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে) ধারণকৃত শেয়ার ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ ও মিসেস আদিবা রহমান (মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে) ধারণকৃত শেয়ার ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের পরিবার থেকে ৫ জন এবং ২০১৮-২০২১ সাল পর্যন্ত ৪ জন পরিচালক কর্মরত ছিলেন। যা বিমা আইনের ২০১০ সালের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
২০১২ সাল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত সরকারের ভ্যাট বাবদ ৩৫ কোটি টাকা এবং ট্যাক্স বাবদ ৩৩০ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, এই দায় কোম্পানির হিসাবে যুক্ত না করে উদ্বৃত্ত বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে অতিরিক্ত লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে। এটি কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এছাড়া ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্সে বর্তমান প্রশাসক নিয়োগের আগে কোম্পানির সরকারি রাজস্ব যেমন ভ্যাট, স্টাম্প ডিউটি, অফিস আয়কর পরিশোধের তথ্য চাওয়া হলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে প্রেরণ করা থেকে বিরত থেকেছে।
ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্সের দুর্নীতির বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন খুবই আশাব্যঞ্জক। এখন এ প্রতিবেদনের মধ্যেই যাতে বিষয়টি সীমাবদ্ধ না থাকে। যারা এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কারণ দুর্নীতির টাকাগুলো সাধারণ মানুষের। তিনি আরও বলেন, যারা এটি রক্ষা করবে পরিচালনা পর্ষদ-তারই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। এরমধ্য দিয়ে ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্সের দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। তবে শুধুু এ প্রতিষ্ঠান নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিমা খাতে আরও বড় আকারে অনুসন্ধান করা দরকার।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে ১১ মাস ধরে নিয়মিত পরিচালনা পর্ষদ নেই। বিমা খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠানটি সাড়ে ৮ মাস ধরে চলেছে পরপর তিনজন প্রশাসকের নেতৃত্বে। ৪ মাস করে দায়িত্ব পালন করতে প্রশাসকদের নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। প্রথম দুজন তেমন কিছু করতে না পারায় তৃতীয় প্রশাসক বসানো হয়েছে ১৩ অক্টোবর।
১৯৯৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ডেলটা লাইফের জীবন তহবিল রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী আড়াই হাজার। এর বাইরে সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে ২০ হাজার কর্মী রয়েছেন।