fbpx
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
বাড়িজাতীয়গণপরিবহন মালিকরা মানুষকে জিম্মি করে স্বার্থ হাসিলে মরিয়া

গণপরিবহন মালিকরা মানুষকে জিম্মি করে স্বার্থ হাসিলে মরিয়া

সরকার ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ করে দেন মালিকরা। জিম্মি হয়ে ভোগান্তিতে পড়ে সারাদেশের মানুষ। এ সুযোগে গণপরিবহনের ভাড়া দ্বিগুণ করার তৎপরতা চালাচ্ছেন বাস মালিকরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি দুই বছর আগে দূরপাল্লা ও নগর পরিবহনে যে ভাড়া প্রস্তাব করেছিল, বাস মালিকরা এখন তার চেয়েও বেশি চাইছেন। তাদের দাবি পূরণ হলে বাস ভাড়া বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

বিআরটিএর কমিটি ২০১৯ সালে দূরপাল্লা বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে দুই টাকা সাত পয়সার প্রস্তাব করেছিল। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগর পরিবহনে ভাড়া প্রস্তাব করেছিল কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা বাড়িয়ে দুই টাকা ২১ পয়সা। এখন ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে মালিকরা এ প্রস্তাবের চেয়েও বেশি চাইছেন।

ডিজেলের বর্ধিত মূল্যের সঙ্গে ভাড়া সমন্বয় করতে আজ রোববার ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটির সভা হবে। বাস মালিকদের যুক্তি, শুধু ডিজেলের দাম নয়, গত দুই বছরে বাসের সব ধরনের যন্ত্রাংশের মূল্য, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, বেতন ভাতা ও মুদ্রাস্ম্ফীতি বেড়েছে। তাই ভাড়া ২০১৯ সালের প্রস্তাবের চেয়ে বেশি বাড়াতে হবে। তবে কত করতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব মালিকরা তৈরি করেননি। তারা ব্যয় বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরবেন আজকের সভায়।

এদিকে, আগের দিনের মতো গতকাল শনিবারও বিআরটিসি ছাড়া সারাদেশে কোনো বাস চলেনি। মালিকদের ভাষ্য, লোকসান এড়াতে বাস বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় নেই।

তবে গ্যাসের দাম গত দুই বছরে না বাড়লেও সিএনজিচালিত বাস মালিকরা কেন ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘটে বাস বন্ধ রেখেছেন? এ বিষয়ে মালিক সমিতির ভাষ্য, গত ছয় বছরে গ্যাসের দাম ১৩ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি গ্যাস ইঞ্জিনের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা ২ শতাংশেরও কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস পরিচালনার ২১ খাতের খরচ ধরে ভাড়া নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু ২০১৯ সালে কমিটি যত ব্যয় ধরে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তা অতিরঞ্জিত। এত ব্যয় বাস পরিচালনায় হয় না। দূরপাল্লায় ৩০ শতাংশ ও নগর পরিবহনে ১০ শতাংশ সিট খালি ধরে ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বাসে আসন খালি দূরে থাক, বাদুরঝোলা করে যাত্রী পরিবহন করা হয়।

ব্যয় কমিটির হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচল করা ৫২ আসনের একটি বাসে প্রতি মাসে ১১ হাজার ৯০০ টাকা খরচ হয় মবিল, ফিল্টার ও এয়ার ক্লিনার পাল্টাতে। প্রতি তিন মাসে ব্রেক সু, লাইট ও ক্লাচ প্লেট পরিবর্তনে ২০ হাজার ৩০০ টাকা খরচ হয়। বছরে একবার ইঞ্জিন ওভারহোলিংয়ে আড়াই লাখ টাকা এবং বাসের বডি সংস্কারে তিন বছরে সাড়ে চার লাখ টাকা, অর্থাৎ বছরে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান সমকালকে বলেন, রক্ষণাবেক্ষণে এত খরচ করলে ঢাকার বাসগুলো লক্কড়ঝক্কড় হলো কী করে? প্রতিটি দুর্ঘটনার পর দেখা যায়, বাসের ব্রেক ফেল করেছে। তিন মাসে একবার ব্রেক সু বদল করলে দুর্ঘটনাই হওয়ার কথা নয়।

দুর্ঘটনা তদন্তের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, কোনো বাসেই মাসে একবার ইঞ্জিন অয়েল, ফিল্টার ও এয়ার ক্লিনার বদল কিংবা গ্রিজিং করার নজির নেই।

হাদিউজ্জামান বলেন, ভাড়া নির্ধারণ করতে বছরে একবার আড়াই লাখ টাকায় ইঞ্জিন ওভারহোলিং এবং তিন বছরে একবার সাড়ে চার লাখ টাকায় সংস্কারের যে খরচ দেখানো হয়েছে, তা অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে।

এআরআই পরিচালক আরও বলেন, তিনি হিসাব করে দেখেছেন, ডিজেলের দামের সমন্বয় করতে দূরপাল্লার নন-এসি বাসে কিলোমিটারে আট পয়সা এবং এসি বাসে কিলোমিটারে ২১ পয়সা ভাড়া বাড়ানো যেতে পারে। এর সঙ্গে যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি যোগ করতে হবে। তার পরও ঢাকায় বাসের ভাড়া কিছুতেই কিলোমিটারে দুই টাকা ৫০ পয়সার বেশি হওয়া উচিত নয়।

ড. হাদিউজ্জামানের মতে, একটি সুস্থ শহরে একজন মানুষের যাতায়াত খরচের সর্বোচ্চ সীমা বা ‘কাট অব পয়েন্ট’ তার আয়ের ১০ শতাংশের কম হওয়া উচিত। ঢাকায় এখন সেটা ২০ শতাংশ। বাস ভাড়া বাড়লে তা আরও বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেন, কত ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে- এমন কোনো প্রস্তাব তারা দেবেন না। গত দুই বছরে ডিজেলসহ অন্যান্য খরচ ও পরিচালন ব্যয় যতটা বেড়েছে, তা তুলে ধরবেন বৈঠকে। খরচ বৃদ্ধির অনুপাতে ভাড়া বাড়াতে চান তারা।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, অতিরঞ্জিত ব্যয় ধরে ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজারদর এবং বাস্তবে রক্ষণাবেক্ষণে যতটা খরচ হয়, তা ধরলে ভাড়া বৃদ্ধির দরকারই নেই।

২০১৯ সালের ব্যয় বিশ্নেষণ অনুযায়ী, নগর পরিবহনে ৫২ আসনের দূরপাল্লার বাসও মাসে ২৫ দিন, অর্থাৎ বছরে ৩০০ দিন চলে। দিনে গড়ে ৩৫০ কিলোমিটার চলে। তাতে ৬৫ টাকা লিটার হিসাবে মাসে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ডিজেল লাগে। দাম বাড়ায় এ খরচ বেড়ে হয়েছে সাত লাখ টাকা। এক লিটার ডিজেলে সোয়া কিলোমিটার পথ চলে দূরপাল্লার বাস। ৭০ শতাংশ আসন পূর্ণ ধরে যাত্রীপ্রতি কিলোমিটারে ৬৭ পয়সার ডিজেল খরচ হবে। ২০১৯ সালের হিসাবে যা ছিল ৫৫ পয়সা। এ বাড়তি খরচ ধরে ভাড়া নির্ধারণের দাবি তুলেছেন মালিকরা। নগর পরিবহনের মতো দূরপাল্লার বাসেও যন্ত্রাংশের ‘বর্ধিত’ দামের হিসাব বৈঠকে দেবেন মালিকরা।

বিআরটিএর কমিটির ব্যয় বিশ্নেষণে বলা হয়েছে, ৩৫ লাখ টাকার একটি বাস ঢাকায় ১০ বছর চলে। ৭৫ লাখ টাকার বাস মহাসড়কে একই সময় চলে। এ অঙ্ককেও ভুল বলছেন পরিবহন খাত-সংশ্নিষ্টরা। ব্যয় বিশ্নেষণে বাসের বিনিয়োগ হিসাবে প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা ৭৭ পয়সা খরচ হয়। দূরপাল্লায় এ খরচ ১০ টাকা ১৫ পয়সা।

৫২ আসন ধরে হিসাব করা হলেও দূরপাল্লার অধিকাংশ বাসে আসন ৪০টি। ফলে ভাড়াও সেই অনুপাতে বাড়বে। ২০১৯ সালের প্রস্তাব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও ৪০ আসনের বাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া হবে দুই টাকা ৬৯ পয়সা। ডিজেলের দাম কমায় ২০১৫ সালে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া কিলোমিটারে তিন পয়সা কমিয়ে এক টাকা ৪২ নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে ৪০ আসনের বাসের ভাড়া হয় কিলোমিটারে এক টাকা ৮৫ পয়সা। এ হিসাবে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ১১৩ কিলোমিটার পথে ভাড়া ২০১ টাকা। ২০১৯ সালের প্রস্তাব কার্যকর হলে এই ভাড়া বেড়ে হবে ৩০৩ টাকা। উত্তরবঙ্গ জেলায় যেতে পথে সেতুর টোল যোগ হবে ভাড়ার সঙ্গে। দক্ষিণের জেলায় যেতে ফেরির খরচও যোগ হবে ভাড়ার সঙ্গে। গত ২ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সেতুতে বাসের টোল ১৫০ বেড়ে ৯৫০ টাকা হয়েছে। এই হিসাবে যাত্রীকে প্রতি যাত্রায় টোল দিতে হবে ২৩ টাকা ৭৫ পয়সা।

বাস ভাড়া বাড়লে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেছেন, যন্ত্রাংশ ও তেলের খরচ যা বেড়েছে, তা লোকসান ঠেকাতে দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারে তিন টাকা ভাড়া হওয়া উচিত।

ভাড়া কত বাড়বে- এ বিষয়ে জানতে বারবার চেষ্টা করেও গতকাল সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে বলা যায়নি।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, বিআরটিএ ভাড়া নির্ধারণ করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সরকার তা অনুমোদন করলে কার্যকর হবে। বিআরটিএর প্রস্তাব থেকে ভাড়া কমানোর ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে। ২০১৫ সালে ঢাকার বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ১২ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল বিআরটিএ। তবে মন্ত্রণালয় ১০ পয়সা বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়।

রাজধানীর দিশারী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহারাজ হোসেন বলেছেন, এককালে তার কোম্পানিতে ৪০টি বাস গ্যাসে চলত। গ্যাসে চললে বাসের ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন সব ডিজেলে চালান। তাই সব বাসেরই ভাড়া বাড়ানো উচিত।

তবে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান তাদের ২০১৮ সালের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার ৮০ ভাগ বাস গ্যাসে চলত। এখন হয়তো তা কমেছে; কিন্তু তা সমিতির মালিকদের দাবিমতো মাত্র ২ শতাংশ নয়।

ট্রাক ও পণ্যবাহী যানবাহনের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না। কিন্তু এসব গাড়ির মালিক ঘোষণা দিয়ে ধর্মঘট ডেকেছেন। পণ্য পরিবহনের নেতাদের একাংশ গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করে। ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাঙ্কার লরি প্রাইম মুভার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব তালুকদার মোহাম্মদ মনির সমকালকে বলেন, আমরা মন্ত্রীকে জানিয়েছি, তেলের দাম না কমালে গাড়ি চালাব না।

তালুকদার মনির বলেন, ট্রাকের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না। তবে বছরের শুরুতেই ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। চুক্তির বেশি টাকা তারা দেবে না। ডিজেলের দাম বাড়ায় চুক্তি অনুযায়ী চললে পণ্যবাহী গাড়ির মালিকের লোকসান হবে। সূত্রঃ সমকাল।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

Recent Comments