সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সরকার “কঠোর ব্যবস্থা” নেওয়া হবে।’
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে অভিযান শুরু হয়েছে। কোনো পরিবহন মালিক-কর্মী এমন কাজ করলে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
কোন হুশিয়ারিই আমলে নেননি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।
গতকাল সোমবার থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে যাত্রীবাহী যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভাড়া নিয়ে জবরদস্তি, যাত্রী হয়রানি, জুলুম আর নৈরাজ্যের অরাজকতা । আন্তঃনগর কিংবা আন্তঃজেলা সব রুটেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় কিংবা যাত্রী হয়রানির অসংখ্য্য ঘটনার খবর মিললেও কোন পরিবহন সংস্থার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থ্যা, জরিমানা কিংবা সাজা দেওয়ার কোন খবর মেলেনি।
রোববার ভাড়া বাড়ানোর দাবি পূরণ হওয়ায় ধর্মঘট তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন বাস মালিকরা। যাত্রী পরিবহন খাতে পুনর্নির্ধারিত ভাড়া কার্যকরের প্রথম দিনেই নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ বাস ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করেছে। অবশ্য সরকারিভাবে গতকাল পর্যন্ত ভাড়ার তালিকা সরবরাহ করা হয়নি। বাস মালিকরা যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই ভাড়া আদায় হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কে জুলুম হিসেবে দেখছেন সাধারণ মানুষ। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সাথে বাক-বিতন্ডা এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে ছিলেন। তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় কিংবা যাত্রী হয়রানির অসংখ্য্য ঘটনার খবর মিললেও কোন পরিবহন সংস্থার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থ্যা, জরিমানা কিংবা সাজা দেওয়ার কোন খবর মেলেনি।
সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাস ভাড়া বেড়েছে শুধু ডিজেলচালিত বাহনে। পেট্রল, অকটেন, সিএনজি চালিত বাহনে বর্ধিত ভাড়া প্রযোজ্য নয়। কিন্তু গতকাল ঢাকা মহানগরীতে সব বাসেই বেশি ভাড়া নেওয়া হয়।
অনেক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এক রাতেই সিএনজিচালিত সব বাস ডিজেলে রূপান্তর হয়ে গেল!’ অন্যদিকে মালিকরা বলছেন, তাদের কোনো বাসই নাকি গ্যাসে চলে না।যাত্রীদের কাছ থেকে কোনোভাবেই যেন নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি না নেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের গতকাল আহ্বান জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সরকার “কঠোর ব্যবস্থা” নেওয়া হবে।’
প্রায় একই কথা বলেছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারও। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে অভিযান শুরু হয়েছে। কোনো পরিবহন মালিক-কর্মী এমন কাজ করলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। সিএনজিচালিত বাস যেন ডিজেলচালিত বাসের হারে ভাড়া নিতে না পারে, তাও দেখা হবে।’
কোন হুশিয়ারিই আমলে নেননি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। গতকাল সকালে রাজধানীতে সরেজমিন দেখা যায়, ঠিকানা পরিবহনে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে চাঁনখারপুল পর্যন্ত আগে ভাড়া নেওয়া হতো ৫ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। গাবতলী থেকে মতিঝিলের দূরত্ব ১১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা হিসাবে এ পথের ভাড়া ছিল ২০ টাকা। কিন্তু বাসে নিত ২৫ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় ৪৫ পয়সা বেড়ে কিলোমিটারে বাসের ভাড়া হয়েছে দুই টাকা ১৫ পয়সা। সেই হিসাবে মতিঝিল-গাবতলীর ভাড়া হবে ২৫ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা।
হাতিরঝিল চক্রাকার বাসে বাড্ডা/রামপুরা থেকে এফডিসি পর্যন্ত আগে নেওয়া হতো ১০ টাকা; এখন তা ১৫ টাকা করা হয়েছে। শেওড়াপাড়া থেকে ফার্মগেটে আগে ভাড়া নেওয়া হতো ৮ টাকা, গতকাল থেকে তা ২০ টাকা করা হয়েছে।
মিরপুর, আজিমপুর, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, বাড্ডাসহ আরও কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। মতিঝিল থেকে মহাখালী পর্যন্ত যাত্রী যেখানেই নামুক, ‘আল মক্কা পরিবহনে’ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা। আগে ছিল ২০ টাকা।
স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীদের অনেকে বাড়তি ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে অনেক জায়গায় বাসকর্মীদের সঙ্গে তাদের বাক-বিতন্ডা, আবার কোথাও কোথাও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। প্রজাপতি পরিবহনের চালকের সহকারী জানালেন, ‘শতকরা ৮০ জনের সাথে ভাড়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। চিৎকার চেঁচামিচি হচ্ছে। গালাগালও দিচ্ছে।’
মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে গাবতলী যেতে ক্যান্টনমেন্ট পরিবহন আগে ১০ টাকা করে নিলেও গতকাল ২০ টাকা করে নিয়েছে। মোহনা পরিবহনে সাভারের ফ্যান্টাসি কিংডম পর্যন্ত ভাড়া করা হয়েছে ৫৫ টাকা, আগে ছিল ৪০ টাকা। মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত আলিফ পরিবহন এখন ৬৫ টাকা করে নিচ্ছে। এ পরিবহনের কয়েক কর্মী জানান, এতদিন তারা ৫০ টাকা করে নিতেন। অবশ্য সেটাও ছিল নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি। যে কোনো বাসে মিরপুর ১০ থেকে মিরপুর-১ নম্বর গোল চত্বরে যেতে চাইলে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। মিরপুর-১ নম্বরে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের এক বাসের হেলপার জানান, শাহবাগ পর্যন্ত যেতে এখন ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৬ টাকা, যা আগে ২০ টাকা ছিল। এ ক্ষেত্রে ভাড়া বেড়েছে ৩০ শতাংশ। বসুমতি পরিবহনে মিরপুর-১ নম্বর থেকে গাবতলী যেতে ১০ টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে, যা আগে ৫ থেকে ৭ টাকার মধ্যে ছিল। বাড্ডা, রামপুরা, মৌচাক এলাকার বাসেও একই হাল।
একই অবস্থা দূরপাল্লার বাসেও। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আগে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ছিল ৪৪২ টাকা। এখন হয়েছে ৫৫২ টাকা। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে ৬০০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আবার ঢাকা-সিলেট রুটে ৪৫৪ টাকার ভাড়া ৫৯৭ টাকা করা হয়। কিন্তু ৭০০ টাকা করেও নেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের দূরত্ব ৪২৪ কিলোমিটার। ৫১ আসনের বাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া এক টাকা ৪২ পয়সা হলেও ৪০ আসনের বাসে ভাড়া ছিল এক টাকা ৮১ পয়সা। এ হিসাবে ৪২৪ কিলোমিটার পথের ভাড়া ছিল ৭৬৭ টাকা ৬৫ পয়সা। সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল যোগ হয়ে ভাড়া পড়ত ৭৯৯ টাকা। হানিফ পরিবহনের বাসে নেওয়া হতো ৮৫০ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় ৫২ আসনের বাসে (২০১৩ সালে ৫১ আসন ধরে ভাড়া হিসাব করা হয়েছিল) কিলোমিটারে ভাড়া হয়েছে এক টাকা ৮০ পয়সা। ৪০ আসনের বাসে এ ভাড়া হবে দুই টাকা ৩৪ পয়সা। এ হিসাবে ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে ভাড়া পড়বে ৯৯২ টাকা ১৬ পয়সা। সেতুর টোল প্রতি বাসে ১০০ টাকা বেড়ে হাজার টাকা হয়েছে। বাসে আসনের ৭০ শতাংশ যাত্রী ধরে জনপ্রতি টোল ৩৫ টাকা ৭১ পয়সা। সব মিলিয়ে আদায়যোগ্য ভাড়া হবে এক হাজার ২৮ টাকা। হানিফ পরিবহনের বাসে নেওয়া হচ্ছে এক হাজার ৮০ টাকা।
ঢাকা-সিলেট রুটে শ্যামলী এনআর পরিবহনের বাসে ভাড়া ছিল ৪৭০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৬০০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। ন্যাশনাল পরিবহন ঢাকা-রাজশাহী রুটের ভাড়া ৪৩৩ থেকে ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫৮০ টাকা নিচ্ছে। হানিফ পরিবহন ঢাকা-ঠাকুরগাঁও রুটের ৭৩২ টাকার ভাড়া ৩৬ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার টাকা নিচ্ছে। ঢাকা-রাজশাহী রুটে দূরত্ব ২৪৭ কিলোমিটার। ৪৭৮ টাকার ভাড়া সরকারি হিসাবে এখন ৬০১ টাকা। নেওয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। এ রকম প্রায় সব রুটেই বাড়তি ভাড়া আদায় করার অভিযোগ এসেছে।
এদিকে ভাড়া নির্ধারণের ব্যয় বিশ্লেষণে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। একাধিক পরিবহন বিশ্লেষক জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম চলাচল করা ৫২ আসনের একটি বাসে মাসে ১১ হাজার ৯০০ টাকা খরচ দেখানো হয় ইঞ্জিন অয়েল, মবিল, ফিল্টার ও এয়ার ক্লিনার বদল করতে। প্রতি তিন মাসে ব্রেক সু, লাইট ও ক্লাচ প্লেট পরিবর্তনে ২০ হাজার ৩০০ টাকা খরচ দেখানো হয়। বছরে একবার ইঞ্জিন ওভার হোলিংয়ে আড়াই লাখ টাকা এবং বাসের বডি সংস্কারে তিন বছরে সাড়ে চার লাখ টাকা অর্থাৎ বছরে দেড় লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। রক্ষণাবেক্ষণে এত খরচ করলে ঢাকার বাসগুলো লক্কড়ঝক্কড় হলো কী করে! প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার পর দেখা যায় বাসের ব্রেক ফেইল করেছিল। তিন মাসে একবার ব্রেক সু বদল করলে এমনটা ঘটার কথা নয়। বাস্তবে কোনো বাসেই মাসে একবার ইঞ্জিন অয়েল, মবিল, ফিল্টার ও এয়ার ক্লিনার বদল করার নজির নেই।
পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাসে বছরে একবারের বেশি টায়ার বদল করা হয় না। একাধিক মালিক বলেছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় টায়ার ‘রিট্রেডিং’ বা ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পর ওপরে প্রলেপ দিয়ে চালানো হয়।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, ‘অতিরঞ্জিত ব্যয় ধরে ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজার দর ও বাস্তবে রক্ষণাবেক্ষণে যতটা খরচ হয়, তা ধরলে ভাড়া বৃদ্ধির দরকারই নেই।’
ব্যয় বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ৩৫ লাখ টাকার একটি বাস ঢাকায় ১০ বছর চলে। ৭৫ লাখ টাকার বাস মহাসড়কে একই সময় চলে। এ অঙ্ককেও ভুল বলছেন পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা।
যাত্রীকল্যাণ সমিতি গতকাল সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছে, ভাড়া নির্ধারণের ব্যয় বিশ্লেষণে পুরনো বাসকে নতুন বাস হিসেবে দেখানো হয়েছে। চালক-হেলপারদের বেতন, বোনাস দেওয়ার মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছে মালিকপক্ষ। ২০ বছর আগে কেনা বাসেও ব্যাংক লোন দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি মনে করছে, মুনাফা লুটপাটের সুযোগ দিতে সরকার মালিকদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একচেটিয়াভাবে ভাড়া বাড়িয়েছে।