সচেতন বার্তা, ১৯ জুলাই: ধর্ষণ ও ধর্ষণপরবর্তী হত্যা মামলার বিচার আইনে নির্ধারিত ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্ট সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, আইনসচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বলা হয়েছে।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। পৃথক তিনটি ধর্ষণ মামলার চার আসামির জামিন আবেদনের ওপর আদেশ দেওয়ার সময় আদালত এই নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালত বলেন, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হবে আর সেই মামলার বিচার তাড়াতাড়ি হবে না, এটা হতাশাজনক ও দুঃখজনক।
আইন অনুযায়ী নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তি করতে না পারলে সুপ্রিম কোর্টকে তা অবহিত করার বিধান থাকলেও নিম্ন আদালতের বিচারক ও সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তা (পিপি) সুপ্রিম কোর্টকে না জানানোয় হাইকোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আদালত বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে না পারলে আইন অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। কিন্তু তা তাঁরা করছেন না। এ কারণে এর আগে আমরা একটি আদেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরও তাঁরা সুপ্রিম কোর্টকে অবহিত করছেন না।
হাইকোর্টের সাত দফা নির্দেশনা দেওয়ার আদেশের কিছুক্ষণ পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থিত হন। সে সময় আদালত আদেশের তথ্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে অবহিত করেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ ধরনের ঘটনা তাত্ক্ষণিকভাবে বিচারের জন্য একজন বিচারক স্ট্যান্ডবাই থাকবেন। অভিযোগ পাওয়ার পর ভিকটিমকে মেডিক্যাল অফিসারের কাছে তিনি নিয়ে যাবেন। এরপর রিপোর্টের ভিত্তিতে তাত্ক্ষণিক বিচার করে ফেলতে হবে। দ্রুত বিচার ছাড়া এজাতীয় ঘটনার প্রবণতা কমানো যাবে না। আদালত বলেন, একটি ইয়ং মেয়ে বা শিশু ভিকটিম হবে আর বিচার বিলম্বিত হবে, তা হতে পারে না। ভিকটিমের তো একটা ভবিষ্যৎ রয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের উল্লিখিত মন্তব্যের পর আদালত বিচারকদের অনীহা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এই আদেশের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ধর্ষণের মামলা আইনে নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হওয়ায় হাইকোর্ট সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্দেশ দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এলাকায় এলাকায় কমিটি গঠন করতে হবে। ধর্ষণের বিচার খুবই দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
হাইকোর্টের সাত দফা নির্দেশনা হলো—
১. দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসমূহে বিচারাধীন ধর্ষণ এবং ধর্ষণপরবর্তী হত্যা মামলাসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইনের নির্ধারিত সময়সীমার (বিচারের জন্য মামলাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিন) মধ্যে যাতে বিচারকাজ সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
২. ট্রাইব্যুনালসমূহকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ধারা ২০-এর বিধান অনুযায়ী মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে।
৩. ধার্য তারিখে সাক্ষী উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে পাবলিক প্রসিকিউটর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবেন এবং কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতি মাসে সুপ্রিম কোর্ট, স্বরাষ্ট্র ও আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন। যে সমস্ত জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সে সমস্ত জেলায় সব ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরগণ মনিটরিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং তাঁদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।
৪. ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সংগত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটির কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
৫. মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের ওপর দ্রুততম সময়ে যাতে সমন জারি করা যায় সে বিষয়েও মনিটর করবে।
৬. ধার্য তারিখে সমন পাওয়ার পরও অফিশিয়াল সাক্ষীগণ; যেমন—ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সন্তোষজনক কারণ ব্যতিরেকে সাক্ষ্য প্রদানে উপস্থিত না হলে ট্রাইব্যুনাল উক্ত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ এবং প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ প্রদান বিবেচনা করবেন।
৭. আদালতের সুচিন্তিত অভিমত এই যে অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে যে সরকার অতি স্বল্প সময়ে উক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে।
নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অত্র আদেশের কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, আইনসচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে দেওয়া হয়েছে।