সরকারি হিসাবেই দেশে বেড়েছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার ঘটনাও বেড়েছে। নির্যাতনের সংখ্যার পাশাপাশি আগের চেয়ে ভয়াবহতা বেড়েছে। একটা ঘটনা বীভৎসতায় আগেরটি ছাপিয়ে যাচ্ছে। পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বস্তরে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু ঘটনার তুলনায় মামলার সংখ্যা কম। মামলার তুলনায় আবার বিচারের সংখ্যা অনেক কম। ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রেই আসামিরা পার পেয়ে যায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরেই জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ৫৯৫ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত আট মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৫৬ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩৬ নারীকে। ১৩৮ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯৯ নারী।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে, গত অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে এ-সংক্রান্ত মামলাও বেশি হয়েছে।
গত ২২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, গত বছরে ধর্ষণ মামলা ছিল পাঁচ হাজার ৮৪২টি, এ বছর তা বেড়ে হয়েছে সাত হাজার ২২২টি। গত বছর নারী নির্যাতনের মামলা ছিল ১২ হাজার ৬৬০টি, এবার বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৭টি। আগের বছরের চেয়ে এ বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে এক হাজার ৩৮০টি; নারী নির্যাতন বেড়েছে এক হাজার ৯৭টি।
চলতি অর্থবছর দেশে মোট মামলা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬২টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলা প্রায় ৪ শতাংশ, ২১ হাজার ৭৮৯টি।
১৩টি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৬১টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১১৩টি এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬০টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৯৪টি। ধর্ষণসহ অন্যান্য সহিংসতার ঘটনায় মামলা হয়েছে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৮৮টি এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪৪টি। এ ছাড়া হত্যা, আত্মহত্যা, অ্যাসিড, অপহরণ, গৃহকর্মী নির্যাতন, সালিশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্যাতনসহ বিভিন্ন সহিংসতায় মোট ৯৭৫টি ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫৭২টি।
মাঝে কয়েক বছর অ্যাসিড সন্ত্রাস তুলনামূলক কমেছিল। কিন্তু করোনা মহামারিতে আবার বেড়েছে অ্যাসিড সন্ত্রাস। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি গত বছর অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন ২১ নারী। চলতি বছর প্রথম ১০ মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হন ১৭ নারী।
কঠোর বিধানেও কমছে না :ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ করা হয়েছে। এর পরও ধর্ষণের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। উল্টো ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার সংখ্যা বাড়ছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা প্রথমেই বলছেন, আইনে ঘাটতির কথা। তাদের ভাষ্য, ধর্ষণের শিকার নারী বিচার চাইতে গেলে প্রথমেই তাকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করা হয়। থানায় মামলা নিতে চায় না। এ ছাড়া সাক্ষ্য আইনের কারণে নিপীড়িত নারীকে আরও বেশি নিপীড়নের শিকার হতে হয়। পাশাপাশি তারা বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কথাও উল্লেখ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন’ আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের বিধিমালা করা হয়নি। বিধিমালা না থাকায় ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলায় একেক বিচারক একেকভাবে বিচার করেন।
মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ যদি বিয়ে ছাড়া কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে, সেখানে ওই নারীর সম্মতি না থাকলে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে তা করা হলে তবেই সেটা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। আইনে ধর্ষণের এ সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করতে হবে। এ কারণে অনেক ঘটনায় সঠিক বিচার হয় না।’
এ ছাড়া একজন নারী যখন ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন, তখন তার মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত এবং বিচার- প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে অবিশ্বাস করা হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
করোনা মহামারির এই সময়ে বিশ্বে হিংসার শিকার হয়ে আগের তুলনায় পাঁচ গুণ মহিলা হেল্পলাইনে ফোন করেছেন বলে ইউএন উইমেনের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। গত বছর মার্চে বাংলাদেশে মহামারি শুরুর পর থেকে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বাড়ার বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেলেও পরিসংখ্যান ছিল না।
আইনজীবী সুরাইয়া পারভীন সমকালকে বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনা ও বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা; অর্থ, ক্ষমতা ও সামাজিক প্রভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নির্যাতনের শিকার শিশু বা তার পরিবার বিচার চাইতেই ভয় কিংবা লজ্জাবোধ করছে। সমাজে ঘটনাগুলো মেনে নেওয়ার মতো প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব নির্যাতনের ঘটনা নারী-পুরুষসহ সব শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-গোষ্ঠীর মানুষের সহাবস্থানের উপাদানগুলোকে ধ্বংস করে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করছে।
আরেক আইনজীবী বলেন, অনেক অভিভাবক হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চান না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার কারণে মামলা চালাতে নারাজ।
আইন অনুযায়ী ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না।
আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। এর অধিকাংশই হত্যা, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি এবং বাল্যবিয়ের মতো ঘটনা। সংস্থাটির নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক বলেন, বাংলাদেশে মাত্র ৩ শতাংশ মামলার বিচার হয়েছে। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস পেয়েছে। তিনি বলেন, নির্যাতনের শিকার হয়েও নারীরা পিছিয়ে নেই। লেখাপড়া, চাকরি এবং মতপ্রকাশেও এখন নারীরা এগিয়ে। ফলে আক্রোশে নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন বদলেছে।
রাজধানীর কয়েকটি থানা ঘুরে অভিযোগ পাওয়া গেছে, থানায় গেলে ভুক্তভোগীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেকে মামলা করলেও আসামিদের ধরা হচ্ছে না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি নৃশংসতার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা সম্ভব হয় না বলে জানান আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান দোলন। তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দোষীদের খুঁজে বের করা বা দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয় না। অপরাধী জামিনে মুক্ত হয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারকে মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করে। এসব কারণে বর্তমান সময়ে ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে ভুক্তভোগী। ফলে মামলায় জড়াতে চায় না তারা।’
নির্যাতনের আসল চিত্র প্রকাশ হচ্ছে না:থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। ফলে ভুক্তভোগী নারী কিংবা কন্যাশিশুর পরিবারের চাপেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি। তিনি বলেন, ‘তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারীর প্রতি সহিসংসতা মামলায় আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়সীমা ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট এখনও দাখিল করা হয় না। পাবলিক প্রসিকিউটরের ভূমিকাও থাকে দ্বন্দ্বপূর্ণ। তারা ভিকটিম ও সাক্ষীকে মামলার তারিখে আদালতে হাজির করানোর ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। এ ছাড়াও বিচারহীনতার সংস্কৃতি তো রয়েছেই। ফলে অনেক ঘটনা চাপা পড়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ কর, সমঅধিকার নিশ্চিত কর’। ১৯৬০ সালের এই দিনে ডোমিনিকান রিপাবলিকে বর্বরোচিত এক নির্যাতনে তিন নারী মারা যান। তাদের স্মরণ করে ১৯৮১ সালে ২৫ নভেম্বরকে নারী নির্যাতনবিরোধী দিবস ঘোষণা করা হয়। এর পর ১৯৯৩ সালে আসে আরেক ঘোষণা। সেবার ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর এ সময়কে করা হয় ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’। তখন থেকে ২৫ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ প্রথম পালন করা হয় ১৯৯৭ সালে।