নভেম্বরের এক হিমশীতল সকালে ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে নিজের বাড়িতে বসে যখন চা পান করছিলেন রাম রাজ, তখন একটা ঘরছাড়া গরু এসে হামলা করল তার ওপর।
পরের কয়েক মিনিট ধরে গরুটি যখন তাকে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে আর পায়ের লাথিতে ক্ষত-বিক্ষত করছে, তখন চিৎকার করতে করতে সে দৃশ্য দেখছিলেন তার নাতি-নাতনিরা। গুরুতর আহত ৫৫ বছর বয়সী রাম রাজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।
“এটি ছিল খুবই বেদনাদায়ক এক মৃত্যুর ঘটনা। আমার শাশুড়ি তার পর থেকে ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন,” বলছিলেন পুত্রবধূ অনিতা কুমারী।
‘ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে এরকম হামলা এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার পর গরুর সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেকগুণ। এতটাই বেড়েছে যে, তা এখন ১০ ফেব্রুয়ারি হতে যে নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
হিন্দুদের কাছে গরু খুবই পবিত্র এক প্রাণী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের আগে পর্যন্ত কৃষকরা তাদের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া গরু নিয়ে যেত কসাইখানায়।
“গরু যখন দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিত অথবা যখন এগুলো দিয়ে আর হালচাষ করা যেত না, তখন আমরা সেগুলো বিক্রি করে দিতাম। যখন আমরা আর্থিক কষ্টে পড়তাম, তখন এটা ছিল আমাদের একটা বিকল্প উপার্জনের উপায়,” বলছিলেন একজন ধানচাষী শিব পুজান।
‘কিন্তু ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এই দলটি দক্ষিণ-পন্থী হিন্দু রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী। ভারতের উত্তরপ্রদেশসহ ১৮টি রাজ্যে এখন গরু জবাই নিষিদ্ধ।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেও বিজেপির এক কট্টরপন্থী নেতা। ২০১৭ সালে তিনি ক্ষমতায় এসেই বেশ কিছু কথিত অবৈধ কসাইখানা বন্ধ করে দেন। যদিও এটি উত্তরপ্রদেশে এক বিরাট ব্যবসা, এই রাজ্য মহিষের মাংসের বড় রফতানি-কারক।’
উত্তরপ্রদেশের গবাদিপশু ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই হয় মুসলিম বা সমাজের দলিত শ্রেণির মানুষ (দলিতরা ভারতের হিন্দুধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নবর্গের মানুষ বলে বিবেচিত, তাদের আগে অস্পৃশ্য বলে বর্ণনা করা হতো)। গোরক্ষার নামে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি বা অন্যান্য স্থানীয় ডানপন্থী সংগঠন যেসব বাহিনী গড়ে তুলেছিল, তাদের হাতে মুসলিম বা দলিত গরু ব্যবসায়ীরা প্রায়শই হামলার শিকার হন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়।
কাজেই গরু কেনা-বেচা করতে গেলে বা গরু পরিবহন করতে গেলে হামলার শিকার হতে পারেন, এমন আশঙ্কায় এদের অনেকে গরু ব্যবসা ছেড়ে দেন।
এরপর তৈরি হয় এক নতুন সমস্যা। কৃষকরা এখন তাদের বুড়ো হয়ে যাওয়া গরু আর বিক্রি করতে পারেন না, এগুলো ছেড়ে দেওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও পথ নেই।
“এখন তো গরু কেনার মতো কেউ নেই। কাজেই কেউ আর গরু বিক্রি করতে পারে না,” বলছেন শিব পুজান। তিনি জানান, এখন তারা তাদের গরু ছেড়ে দেন কাছের ঝোপ-জঙ্গলে।
এসব ছাড়া গরু এখন ঘুরে বেড়ায় উত্তরপ্রদেশের শহরে-গ্রামে। কৃষকরা বলছেন, এসব গরু যখন ক্ষুধার্ত থাকে, তারা খুবই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এরকম একটা গরুই ঢুকে পড়েছিল রাম রাজের বাড়িতে। যখন তারা আতংকিত হয়ে চিৎকার শুরু করেছিলেন, তখন এটি রাম রাজকে আক্রমণ করেছিল।
শিব পুজান নিজেও সম্প্রতি একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। তার ক্ষেতে ঢুকে পড়া এক দল ছাড়া গরুকে যখন তিনি তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, তখন সেগুলোর আক্রমণের মুখে পড়েন তিনি।
“দুটি গরু আমাকে গুঁতো দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে, তখন আমি দৌড়ে কোন রকমে প্রাণ বাঁচাই,” বলছেন তিনি।
তার হাতে এখনও ব্যান্ডেজ লাগানো, দৌড়ে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গাতে গিয়ে তিনি আঘাত পেয়েছিলেন।
‘শিব পুজান একজন ধর্মভীরু হিন্দু। তিনি বিশ্বাস করেন গরু এক পবিত্র প্রাণী। কিন্তু সব গরু রক্ষার নামে সরকার যে ঢালাও নির্দেশ জারি করেছে, তা নিয়ে তিনি ক্ষুব্ধ।
তার মতো কৃষকরা বলছেন, ছাড়া গরু এখন ক্ষেতের ফসল নষ্ট করছে, রাস্তায় দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে এবং লোকজনকে মেরে ফেলছে।
“রাস্তাঘাটে ছাড়া গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে বলেই আজ আমার ছেলেটা এতিম হয়ে গেল। কে এখন আমাদের দেখাশোনা করবে,” বলছেন পুনম দুবে, যার স্বামী একটা ছাড়া ষাঁড়ের হামলায় মারা যান।
ভারতে ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ যখন আঘাত হানে, তখন ৩৬ বছর বয়সী ভুপেন্দ্র দুবে কাজ হারিয়ে তার গ্রামে ফিরে আসেন। স্থানীয় এক বাজারে একদিন যখন তিনি তার ছেলের জন্য মিষ্টি কিনতে গেছেন, তখন একটি ষাঁড়ের হামলায় তিনি নিহত হন।
একশ’ কিলোমিটার দূরের আরেকটি গ্রামে ৮০ বছর বয়সী রাম কালি ২০১৯ সাল হতে কোমায় আছেন, কারণ তিনিও এক গরুর হামলার শিকার হয়েছিলেন। তার পরিবার বলছে, রাম কালি এখনও জানেন না যে তার একমাত্র ছেলে গত বছরের শুরুতে কোভিডে মারা গেছেন।
উত্তরপ্রদেশের বিরোধী দলগুলো এখন এই বিষয়টিকে নির্বাচনী ইস্যু করেছে। এই রাজ্যটিতে কৃষকরা ভোটারদের একটা বড় অংশ।
ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র সমির সিং বলেছেন সমস্যাটি মোকাবেলায় রাজ্য সরকার নতুন কৌশল তৈরি করছে।
“এগুলোকে বেওয়ারিশ গরু বলা ঠিক হবে না, কারণ এসব প্রাণী হিন্দু সংস্কৃতির অংশ। আমাদের পরিবারের কেউ যখন বৃদ্ধ হয়ে যান, তাকে তো আমরা মরার জন্য রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসি না। আমরা এসব গরুকে কিভাবে রাস্তায় রেখে আসছি মরার জন্য?” বলছেন তিনি।
গরুগুলো রাখার কথা ছিল গোশালায়। যোগী আদিত্যানাথের সরকার কোটি কোটি রুপি বরাদ্দ করেছিল রাজ্যে এরকম অনেক গোশালা নির্মাণের জন্য। এসব গোশালা পরিচালনার খরচ নির্বাহের জন্য তারা রাজ্যে অ্যালকোহল বিক্রির ওপর বিশেষ ট্যাক্সও বসিয়েছিল।
কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হয়নি। অযোধ্যায় সরকার পরিচালিত একটি গোশালা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে অনেক গরু, তিলমাত্র জায়গা ফাঁকা নেই।
“এখানে দুইশ’ গরু রাখা হয়েছে, এর চেয়ে বেশি গরু রাখার জায়গা এখানে নেই। কিন্তু এই এলাকায় এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সাতশ’ হতে এক হাজার ছাড়া গরু,” বলছেন এই গোশালার দায়িত্বে থাকা শত্রুঘ্ন তিওয়ারি।
অনেক কৃষক এখন দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা তাদের ক্ষেতে পাহারা বসিয়েছেন। তারা পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দেন প্রচণ্ড শীত আর সাপের কামড়ের ভয় উপেক্ষা করে।
“পুরো গ্রাম থেকে আমরা দলে দলে পালাক্রমে রাতে পাহারা বসাই। রাতের দলের কাজ যখন শেষ হয়, তখন সকালে আরেক দল এসে দায়িত্ব নেয়। রাতজাগা দলটি তখন বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেয়,” বলছেন ৬৪ বছর বয়সী কৃষক বিমলা কুমারী।
পুরো বিষয়টি নিয়ে দিনা নাথের মতো অনেক ভোটার ত্যক্ত-বিরক্ত এবং তারা নির্বাচন বর্জনের কথা ভাবছেন।
আমাদের সমস্যার যদি কোনও সমাধান না হয়, তাহলে ভোট দিয়ে লাভটা কী,বলছেন তিনি।’