বসন্ত মানেই নতুন সাজে প্রকৃতির মুখরিত হওয়ার দিন, ফুল ফোটার দিন। শীতের বিবর্ণতা কাটিয়ে নতুন পাতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠবে রুক্ষ প্রকৃতি। ফাগুনের ঝিরঝিরে বাতাস আর কোকিলের মিষ্টি কুহুতানে মাতাল হবে ধরণি। যৌবনে আসবে উদ্দামতা। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসমুখরতায় ভরে উঠবে মন-প্রাণ।
আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা/কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে’। নেশা-জাগানিয়া এই সময়ে এসেছে ভালোবাসা দিবসও। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের কারণে গত বছর থেকে একই দিনে পালিত হচ্ছে পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। একই দিনে ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারনে পোশাক, খাওয়া-দাওয়া এবং উৎসব আয়োজনে চোখে পড়ছে ভিন্নতা।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসার তরী বাইছেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।
তবে শুধু প্রেমের তো নয়; বিদ্রোহেরও এই বসন্ত। ১৯৮৩ সালের এই দিনে ছাত্র-জনতা বিস্ম্ফোরিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথে সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে। জীবন দিয়েছিলেন জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, দীপালী সাহা প্রমুখ। একইভাবে এবারের বসন্তেও বইছে বিশেষত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদের হাওয়া।
ইটপাথরের স্থাপনাময় রাজধানীতেও রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা নগরের বিভিন্ন স্থানে বেড়ে ওঠা শিমুল-পলাশ-অশোকসহ বিভিন্ন গাছের শাখায় রঙিন ফুলের সমাহার আজ জানাচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝরা পাতারা জানিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির রূপ বদলের কথা। যান্ত্রিক নগরেও তাই নাগরিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ঋতুরাজের আগমনী-উচ্ছ্বাস। কারণ প্রকৃতির বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও মাধুর্য মানুষের মনেও নানা ভাবের প্রকাশ ঘটায়। বিদায়ী শীত এখন ঝরা পাতা নিয়ে অপেক্ষা করছে নতুন পাতার, নতুন সময়ের, নতুন সম্ভাবনার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা।/ বইল প্রাণে দখিন-হাওয়া আগুন-জ্বালা’ বসন্ত যেন এবারও এই বার্তা নিয়ে এসেছে মাঘের শীতের পথ পেরিয়ে। আত্মার গহীনে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসার কথা জানাবে সে। বিদ্রোহের দীপাবলি জ্বালাবে সে পথে পথে।
আজকের এই দিনে তাই কি শিশু-কিশোর কি বৃদ্ধ- সব বয়সী মানুষের ভেতর থেকেই উপচে পড়ছে বসন্তের আবহ। তরুণীদের খোঁপায় আজ লাল-হলুদ গোলাপ, হাতে জড়ানো গাঁদা ফুল। তাদের কেউ সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা আনতে খোঁপায় গুঁজেছে গ্লাডিওলাস, টিউলিপ কিংবা গাজরা। এ দিনে শিশু থেকে যুবা, সবার হাতেই লাল গোলাপ। আজ ফাল্কগ্দুনী দখিনা উদাস হাওয়ায় প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ে বইছে বাঁধভাঙা সৃষ্টির স্বপ্ন। শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে তরুণ-তরুণীর সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আজ নতুনভাবে সেজেছে সারাদেশ।
বরাবরের মতো এবারও নিঃসংশয়ে বলা যায়, রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- সবখানে নামবে তারুণ্যের ঢল। প্রেম ও বিদ্রোহের মিশেলে এমন দিনকে বরণ করতে শাহবাগের ফুলের দোকান আর আজিজ মার্কেটের শাড়ি ও পাঞ্জাবির দোকানে গত কয়েক দিন ধরে দেখা গেছে উপচে পড়া ভিড়। আজ বসন্তের প্রথম দিনে, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে দ্রোহে-ভালোবাসায় জাগছে আকাশ-বাতাস। ফুল, কার্ড, চকলেট বিনিময়ের পাশাপাশি কবিতা ও ছন্দ মিশ্রিত বার্তায় আজ ভরে যাবে মুঠোফোনের ইনবক্স।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপে থাকবে গহীন পরানের উষ্ণতা। টিএসসি, চারুকলা, শিল্পকলা একাডেমি, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বলধা গার্ডেন, বেইলি রোডের ফাস্টফুডের দোকান, ধানমন্ডি লেক ও রবীন্দ্র সরোবরে ছড়িয়ে থাকবে ভালোবাসা ও বসন্তের মিছিল। সারাদেশের মতো রাজধানীর বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানা আয়োজনে আজ বসন্ত ও ভালোবাসাকে উদযাপন করবে। রাজনীতিক-সংগঠকদের দেখা যাবে শহীদ মিনারে গণতন্ত্রের জন্য জীবন দানকারী শহীদের স্মরণে ফুল দিতে; নতুন করে শপথ নিতে।
বসন্ত উৎসব: প্রতি বছরের মতো এবারও ‘বসন্ত উৎসব’ পালন করবে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষৎ। সোহরাওয়ার্দী পার্কে শিল্পকলার উন্মুক্ত মঞ্চে আজ সোমবার সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে উপমহাদেশীয় ধারার এসরাজ বাদ্যযন্ত্রনির্ভর বাসন্তী রাগ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এ উৎসবের শুভ সূচনা হবে। শেষ হবে সকাল ১০টায়। এতে বসন্ত কথন পর্বে অংশ নেবেন সংগঠনের সভাপতি স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদ, সভাপতি কাজল দেবনাথ ও সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট। কভিড-১৯ এর কারণে এবারের উৎসব হবে সীমিত পরিসরে। তাই এবার বসন্ত উৎসব হচ্ছে না উত্তরা, ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর ও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে।
ভালোবাসা দিবসের কথা: বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে ইতিহাসের পাতায় রয়েছে নানা কাহিনী। এগুলোর মধ্যে বহুল প্রচলিত কাহিনীটি হচ্ছে- রোমান পাদ্রি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অভিযোগে ২৭০ সালে মৃত্যুদণ্ড দেন রোমের দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। তিনি কারাগারে বন্দি থাকার সময় ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে জানালা দিয়ে চিঠি ছুড়ে দিত। বন্দি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন চিকিৎসা করে জেলারের মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। এভাবে মেয়েটির সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে। মারা যাওয়ার আগে মেয়েটিকে পাঠানো চিঠির শেষে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন।’
অনেকে মনে করেন, এই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারেই প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ছাড়াও এক ভ্যালেন্টাইনের নাম পাওয়া যায় ইতিহাসে। যুদ্ধের জন্য দক্ষ সৈনিক সংগ্রহের জন্য রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস যুবকদের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। কিন্তু তরুণ এই ভ্যালেন্টাইন নিয়ম ভঙ্গ করে প্রেম ও বিয়ে করেন। এ কারণে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি।