fbpx
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
বাড়িজাতীয়তেলের তেলেসমাতিতে কাটছে ভোক্তার পকেট!

তেলের তেলেসমাতিতে কাটছে ভোক্তার পকেট!

সমকালের প্রতিবেদনঃ ভোজ্যতেল নিয়ে একের পর এক জাহাজ নোঙর করছে বন্দরে। মার্চেই তিন জাহাজে অপরিশোধিত প্রায় ৭৫ হাজার টন সয়াবিন তেল ঢুকেছে দেশে। অপরিশোধিত পাম অয়েলও আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার টন। খুব কাছাকাছি সময়ে ঢুকবে তেলের আরও দুটি জাহাজ। ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসেই চার লাখ টনের বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। ২০২১ সালে আমদানি হয়েছিল অপরিশোধিত ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন তেল। তারপরও সয়াবিন তেলের বাজার টালমাটাল। কমছে না তেলের তেলেসমাতি!

ভোজ্যতেল সংরক্ষণের টার্মিনালেও নেই পর্যাপ্ত তেল। সাধারণত ট্যাঙ্ক টার্মিনালে আপৎকালীন হিসেবে নূ্যনতম ১৫ দিনের তেল মজুত থাকে। অথচ সর্বশেষ জাহাজটি আসার আগে মাত্র ১৪ হাজার টন ভোজ্যতেল মজুত ছিল টার্মিনালে। প্রশ্ন উঠছে, খালাস করা এত ভোজ্যতেল যাচ্ছে কোথায়? ট্যারিফ কমিশনের তথ্য বলছে, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা মাত্র ২০ লাখ টন।

এখন ভোজ্যতেল আমদানি করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল। পাইকাররা বলছেন, আমদানিকারকরাই অবৈধভাবে মজুত করে এই সংকট তৈরি করছেন। নির্দিষ্ট ডিলার দিয়ে সয়াবিন তেল সীমিত আকারে সরবরাহ করছেন তারা। এ জন্য মিলগেটেও চাহিদামতো ভোজ্যতেল মিলছে না।

অন্যদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকেই চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না তারা। পাইকারদের বিরুদ্ধে তেল মজুত করার অভিযোগ তুলছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

ভোজ্যতেল নিয়ে গত ১৭ মার্চ খাতুনগঞ্জে অনুষ্ঠিত বৈঠকে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমেদ বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের পাইকাররা তেল বিক্রি করছেন সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়মে। খুচরা পর্যায়ে সেটি মানা হচ্ছে না। আবার মিলগেট থেকেও চাহিদামতো ভোজ্যতেল পাচ্ছেন না পাইকাররা।’ তিনি অভিযোগ করেন, দাম বাড়লেই পাইকারি বাজারে অভিযান চালানো হয়। গত সপ্তাহেও এক ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এভাবে হুটহাট জরিমানা করলে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। অথচ সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে পরিশোধন কারখানাগুলো বেশি দরে পণ্য বিক্রি করছে।

চাহিদা অনুযায়ী মিলগেটে মিলছে না তেল : চাহিদামতো বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ না হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বেশ কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে এর সত্যতা পান কর্মকর্তারা। কয়েকজন পাইকারের গুদামেও তেল মজুত থাকার প্রমাণ মিলেছে। ঢাকায় সিটি গ্রুপের কারখানায় অভিযান চালানোর পর চট্টগ্রাম এস আলমের সয়াবিন তেল মিলে দ্বিতীয় দফা অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর।

গত রোববার দুপুরে কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক এলাকার এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এস আলম এডিবল অয়েল মিলে সর্বশেষ অভিযান চালানো হয়। এ সময় অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘১৫ দিনের মধ্যে সাপ্লাই অর্ডারের বিপরীতে তেল সরবরাহের নিয়ম রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা সরবরাহ দিতে পারছেন না। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন তারা। আগের চেয়ে তারা তেলের সরবরাহ কিছুটা বাড়িয়েছেন।’ এর আগে গত ১৩ মার্চও কারখানাটিতে অভিযান চালিয়েছিল ভোক্তা অধিদপ্তর। সেদিন কারখানাটির রিফাইনিং ও বোতলজাতকরণ কার্যক্রম তারা বন্ধ পেয়েছিলেন। এ ছাড়া একটি বোতলের মোড়কে সরকার নির্ধারিত দামের বেশি লেখা পেয়েছিলেন তারা।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম অর্ধশত ব্যবসায়ীকে নিয়ে ১৭ মার্চ বৈঠক করা হয়েছে। বৈঠকে মিলগেট থেকে চাহিদামতো তেল না পাওয়ার কথা জানান ব্যবসায়ীরা। আরএম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার শাহেদ উল আলম বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে পাইকারি বাজারে সয়াবিন কম দামে বিক্রি হচ্ছে। এখন নজর দিতে হবে মিলগেট ও খুচরা বাজারে। সেখানে সরকার নির্ধারিত নিয়ম কতটা মানা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’

জবাবে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কেউ তেল বিক্রি করবেন না। মিলগেট থেকে বেশি দামে কেউ তেল আনবেন না। কোনো আমদানিকারক যদি চাহিদামতো তেল না দেন, কিংবা বাড়তি দাম হাঁকান তাহলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানান। খাতুনগঞ্জের বদনাম যাতে কেউ করতে না পারে।’

চট্টগ্রাম বন্দরে আসা সর্বশেষ জাহাজে তেল এনেছে সিটি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘সর্বশেষ যে জাহাজটি এসেছে সেটিতে আমাদের প্রতি টন তেলের দাম পড়েছে প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলার। আগের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে এই জাহাজের তেল। তারপরও আমরা তেল আমদানি স্বাভাবিক রেখেছি। স্বাভাবিক আছে সরবরাহ প্রক্রিয়াও।’ তিনি জানান, নরওয়ের পতাকাবাহী এমভি স্টেভেনজার পাইওনিয়ার জাহাজটি ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলের পরানাগুয়া বন্দর থেকে রওনা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে এই জাহাজের সময় লেগেছে ৩৪ দিন। ভোজ্যতেল সরবরাহে মিলগেটে সংকট নেই বলে জানান তিনি।

মার্চে তিন জাহাজে এলো ৭৫ হাজার টন সয়াবিন :গত রোববার চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ৪২ হাজার ৮৫০ টন অপরিশোধিত সয়াবিন এনেছে সিটি, মেঘনা, বসুন্ধরা, সেনাকল্যাণ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল। ভোজ্যতেল আমদানিতে তিন ধাপে ভ্যাট কমানোর পর সয়াবিন তেল নিয়ে আসা প্রথম জাহাজ এটি। এর আগে ‘এমটি লুকাস’ নামের একটি জাহাজ এনেছে ১২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন। এর মধ্যে টিকে গ্রুপের শবনম ভেজিটেবল অয়েল এনেছে পাঁচ হাজার টন, বে-শিপিং করপোরেশন এনেছে ২ হাজার ৯৭৫ টন এবং সুপার রিফাইনারি এনেছে ৮ হাজার টন। একই দিন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসা ‘এমটি প্যাসিফিক রুবি’ নামের জাহাজে এসেছে ২০ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন। এর মধ্যে রয়েছে মেঘনার ৭ হাজার টন ও সিটির ১০ হাজার টন তেল।

কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার সালাউদ্দিন রিজভী জানান, আমদানি করা অপরিশোধিত সয়াবিন প্রথমে পতেঙ্গার ট্যাঙ্ক টার্মিনালে রাখা হয়। শুল্ক্ক কর দেওয়ার পর আমদানিকারক এটি তাদের কারখানায় পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করেন।

আমদানি ভোজ্যতেলের প্রতি লিটারে ব্যয় কত : বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দর পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইনডেক্স মুন্ডি’র তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বরে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৪১১ ডলার। ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি টনে জাহাজ ভাড়া পড়ে ৭০ ডলার।

সব খরচ মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর প্রতি টন সয়াবিন তেলের দর দাঁড়ায় এক হাজার ৪৮১ ডলার বা ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। এই হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম পড়ে ১২৭ টাকা ৩৬ পয়সা। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বশেষ তেল নিয়ে যে জাহাজটি এসেছে সেটির টন প্রতি দাম পড়েছে প্রায় এক হাজার ৫০০ ডলার। তাতে আগের চেয়ে খরচ বেড়েছে লিটারপ্রতি তিন থেকে চার টাকা। ভ্যাট কমানোয় লিটারপ্রতি সাশ্রয় হয়েছে ১২ টাকা ৬০ পয়সা।

ট্যাক্স-ভ্যাটে ছাড়ের পরও কেন মিলছে না সুফল : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মার্চে দুই দফায় প্রজ্ঞাপন জারি করে সয়াবিন ও পাম অয়েলের ওপর থেকে আমদানি পর্যায়ের ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়েছে। সেই সঙ্গে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। ভ্যাট কমানোয় এই জাহাজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে না সরকার। তবে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। তাতে সরকার রাজস্ব পাবে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। ভ্যাট কমানোর কারণে তেলের দাম লিটার প্রতি ১২ থেকে ১৪ টাকা কম হওয়ার কথা। তবে সে সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা। সেই হারে কমেনি তেলের দাম।

স্কুলশিক্ষক তরুণ কান্তি নাথ বলেন, ‘কাস্টমসে যে ভোজ্যতেলের দাম ১২৭ টাকা, সেটি বাজারে যেতেই কীভাবে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা হয়? এখন দাম আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও ১৭০ টাকার নিচে খুচরা বাজারে কোনো সয়াবিন মিলছে না।’

এখনও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল : গত সপ্তাহে খোলা পাম অয়েলের দাম লিটারে তিন টাকা কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এটি এখন ১৩০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হওয়ার কথা। সরবরাহ কম থাকার ছুতায় খুচরা বাজারে এখনও নির্ধারিত এই দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পাম অয়েল। লিটারে ৫ থেকে ৭ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিনও। গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েল ১৩৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গত মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে খোলা পাম অয়েলের নতুন দরের কথা জানায়। এর আগে গত রোববার এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল আট টাকা ও পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলে সাত টাকা করে কমানো হয়েছিল।

ভোক্তাকে বেশি ভোগাচ্ছে ভোজ্যতেল : ক্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, গত চার বছরে যে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, সয়াবিন ও পাম অয়েল সবার শীর্ষে। ২০১৯ সালে দেশের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল গড়ে ১০৪ টাকা। ২০২০ সালে সেটি বেড়ে হয় ১১৩ টাকা। ২০২১ সালে ১৩০ টাকা। ২০২২ সালের শুরুতে উঠে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা। অন্যদিকে পাম অয়েলের লিটার (খোলা) ২০১৯ সালে ছিল ৫৮ টাকা, ২০২০ সালে ৭৮ টাকা, ২০২১ সালে ১০৭ টাকা এবং ২০২২ সালের শুরুতে ১৬৫ টাকা।

এখন সয়াবিন ও পাম অয়েলের দর আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও খুচরা বাজার থেকে তা সরকার নির্ধারিত দামে কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। লিটার প্রতি ভোক্তাদের চার থেকে সাত টাকা বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

Recent Comments