প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ, রক্তে ভিজছে সড়ক। কারও হচ্ছে জীবন সাঙ্গ, আবার কেউ হারাচ্ছেন শরীরের প্রিয় অঙ্গ। কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আসছে না সড়ক নৈরাজ্য। সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা গণপরিবহনের জাঁতাকলে পড়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে একেকটি পরিবার।
নতুন করে ঢাকাতে ভীতি ছড়িয়েছে সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর রাজপথে ময়লার গাড়ি ভয়ংকর এক বাহনের নাম। তবে ময়লার গাড়ি দুর্ঘটনার বেশিরভাগেরই হয় না মামলা, হলেও শেষ হয় না তদন্ত। এই ধরনের গাড়ির ধাক্কা বা চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ হলেও থানা পুলিশের মধ্যস্থতায় তা মীমাংসা হয়ে যাচ্ছে। শাস্তি না হওয়ায় ময়লাবাহী গাড়ির চালকরা দুর্ঘটনার নামে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহত হয়েছেন নাসরিন খানম (২১) নামে এক নারী। ওই ঘটনায়ও মামলা হয়নি। নাসরিনের পরিবারের সঙ্গে গাড়ি চালকের হয়ে গেছে ‘মীমাংসা’। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গাবতলীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী একটি গাড়িচাপায় দুই পা কাটা পড়ে শ্রমিক রুস্তম আলীর। চিরতরে পঙ্গু ওই ব্যক্তির সঙ্গেও গাড়িচালকের মীমাংসা হয়েছে। এর মধ্যস্থতায়ও ছিল পুলিশ।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ মনজিল মোরসেদ বলছেন, ছোটখাটো দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে দু’পক্ষ মিলে গেলে পুলিশের কিছুই করার থাকে না। তবে গাড়িচাপা বা ধাক্কায় কেউ নিহত হলে, কারও অঙ্গহানি ঘটলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ। এই ঘটনায় মামলা হতে হবে। এখানে আইন অনুযায়ী আদালতের বাইরে মীমাংসার কোনো সুযোগ নেই।
কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের মধ্যস্থতায় মীমাংসা হলেও কাগজপত্রে তার প্রমাণ থাকে না। এ ক্ষেত্রে ভিকটিম পরিবার মামলা করতে চায়নি কিংবা তারা ঘটনাটি মীমাংসা করে ফেলেছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
যদিও আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলছেন, গাড়িচাপায় মৃত্যুর ঘটনায় ভিকটিম পরিবার মামলা করতে না চাইলে পুলিশ বাদী হয়ে তা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ভিকটিম পরিবার আদালতে সাক্ষ্য দিতে না গেলে সে মামলাটি টেকানো যায় না।
পুলিশ ও পরিবার জানায়, শুক্রবার রাত ৮টার দিকে নাসরিন তার স্বামী মো. শিপনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চড়ে গোড়ানের বাসা থেকে তালতলা যাচ্ছিলেন। তিলপাপাড়ার ৮ নম্বর সড়কে ময়লাবাহী গাড়ি মোটরসাইকেলে চাপা দিলে নাসরিন প্রাণ হারান, স্বামীও আহত হন। ওই ঘটনায় গাড়িচালক বকুল মিয়াকে আটক করা হলেও পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই ঘটনায় মামলা না হওয়ার বিষয়ে খিলগাঁও থানার ওসি ফারুকুল আলম বলেন, তাদের অনুরোধ করলেও পরিবারটি মামলা করতে চায়নি। তারা লাশের ময়নাতদন্ত এমনকি সুরতহাল প্রতিবেদনও তৈরি করতে দেয়নি। এজন্য পুলিশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করেছে। তারা অভিযুক্ত গাড়িচালকের সঙ্গে কোনো মীমাংসা করেছেন কিনা জানি না।
ওসি বলেন, ভিকটিমের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। যদি কেউ না থাকতেন, সে ক্ষেত্রে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করত। তারা তা না চাওয়ায় মামলা না করেই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
নাসরিনের স্বামী মো. শিপন বলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় তাৎক্ষণিকভাবে মামলা করতে চাইনি আমরা। স্ত্রীর লাশও আর কাটাছেঁড়া করতে চাইনি। তবে এ ঘটনার বিচার চাই।
নাসরিনের ভগ্নিপতি শফিকুল ইসলাম লিটন বলেন, গাড়িটি সিটি করপোরেশনের। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ তো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মামলা করে পারব না। দৌড়ঝাঁপ দিতে দিতে, টাকা খরচ করে আরও হয়রানি হতে হবে। এজন্য তারা মামলা না করেই লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
এদিকে গাবতলীতে ময়লার গাড়িতে দুই পা হারানো রুস্তম আলী জানান, তার বাড়ি রাজশাহী। ঢাকায় কাজের খোঁজে গিয়ে দুই পা হারিয়েছেন। এতে থানায় দৌড়াদৌড়ি করার মতো তার অবস্থা নেই। পুলিশ আসামি ধরেছিল। তিনি চিকিৎসা খরচ পেয়ে পুলিশের পরামর্শেই গাড়িচালকের সঙ্গে ঘটনাটি মীমাংসা করেছেন। রুস্তমের এক স্বজন জানান, গাড়িচালক ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই লাখ টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে রুস্তমের চিকিৎসা খরচ চালানো হচ্ছে।
মামলা হলেও তদন্ত শেষ হয় না: ময়লার গাড়িতে নিহত হওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে কোনো কোনো ঘটনায় মামলা হয়। তবে দীর্ঘদিনেও এসব মামলার তদন্ত শেষ হয় না। অনেক ঘটনায় তদন্ত শেষ হলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেওয়া হয়। গত ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাঈম হাসান নামে নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হন। ওই ঘটনায় মামলা হলেও চার মাসেও তদন্ত শেষ হয়নি। ওই ঘটনার পরের দিনই পান্থপথ এলাকায় ময়লার গাড়িচাপায় নিহত হন কবির খান নামে এক ব্যক্তি। এই ঘটনায় মামলা হলেও তদন্ত শেষ হয়নি।
এ ছাড়া ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দয়াগঞ্জে, ওই বছরের এপ্রিলে যাত্রাবাড়ীতে, মে মাসে টিটিপাড়া এলাকায় এবং আগস্টে শ্যামপুরে ময়লার গাড়িচাপায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায়ও বিচার পায়নি নিহতের পরিবার।
সূত্রঃ সমকাল।