সমকালের প্রতিবেদনঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রামের মা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস আরা বেগম পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। এরপর তার উত্তরসূরি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতে আবেদন করেন রুনা বেগম। সেই অনুযায়ী তাকে ভাতা দিয়ে আসছিল সরকার। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিনি বোনাসসহ সাত লাখ ৫৫ হাজার টাকা তুলে নেন। এরপর কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে বড় রকমের জালিয়াতি।
সোনালী ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট শাখার প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, রুনা আসলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নন। জাল কাগজপত্র দিয়ে মিথ্যা পরিচয়ে তিনি ভাতা তুলে আসছিলেন। শুধু তাই নয়, ওই মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত নমিনিও নাসিরনগরে ঠিকঠাক ভাতা পেয়ে আসছেন। অর্থাৎ একজনের প্রাপ্য ভাতা প্রকৃত উত্তরসূরি ও জালিয়াত দু’জনই পেয়েছেন।
এ ঘটনা ধরা পড়ার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঢাকার লালবাগ থানায় মামলা করে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় রুনা বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্ত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, মামলার অন্য আসামি শেখ শাহজালাল এই জালিয়াতির মূল হোতা। তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। এক্ষেত্রে তিনি রুনাকে ব্যবহার করেছেন। বিনিময়ে দিয়েছেন মাসে এক-দেড় হাজার টাকা।
এদিকে ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ে দুর্বলতার বিষয়টি এখন স্পষ্ট। তবে এর দায় নিতে রাজি নয় কোনো পক্ষই। সোনালী ব্যাংক ও সমাজসেবা অফিস নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা বলে দায় এড়াচ্ছে। সেইসঙ্গে তারা জানিয়েছে, এটিই একমাত্র ঘটনা নয়। এমন আরও কিছু জালিয়াতির ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
প্রয়াত ফেরদৌস আরা বেগম মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও কে-ফোর্সের সর্বাধিনায়ক খালেদ মোশাররফের বোন। তার ছেলে এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস দিয়ে জানান, ওমরাহ করার উদ্দেশে তিনি সৌদি আরবের মক্কায় রয়েছেন। আপাতত তিনি কথা বলতে পারবেন না। তবে তার ব্যক্তিগত সহকারী আজহারুল হোসেন মহসীন সমকালকে বলেন, জালিয়াতির বিষয়টি সম্পর্কে আমরা মামলা হওয়ার পর জানতে পেরেছি। এ ব্যাপারে আমরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। অভিযুক্ত নারী ফেরদৌস আরা বেগমের কেউ নন।
সোনালী ব্যাংকের লালবাগ শাখার ব্যবস্থাপক ছাদেকুর রহমান সমকালকে বলেন, শহর সমাজসেবা কার্যালয়-৫ (আজিমপুর, লালবাগ) থেকে ইস্যু করা ডিহাফ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বইয়ের মাধ্যমে এবং শেখ শাহজালালের পরিচয়ে রুনা বেগম এই শাখায় হিসাব খোলেন। ওই হিসাব নম্বরের অনুকূলে ব্যাংক তার নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা তোলার চেকবই ইস্যু করে। এখানে ব্যাংকের কোনো গাফিলতি ছিল না। কারণ সমাজসেবা অফিস থেকে সব কাগজপত্র যাচাই করে হিসাব খোলার জন্য এখানে পাঠানো হয়। তা ছাড়া ২০২০ সালের আগে অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না। পরে যাচাই করতে গিয়ে আরও অন্তত আটটি হিসাব নম্বরের কাগজপত্রে সমস্যা পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রমাণ সাপেক্ষে ওইসব হিসাবধারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ব্যাংকের পক্ষ থেকে করা মামলাটির বাদী হয়েছেন সোনালী ব্যাংকের লালবাগ রোড শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার আনোয়ার হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী রুনা বেগম ঢাকার আজিমপুর রোডের ৩৫/সি নম্বর বাসায় থাকেন। তার স্বামীর নাম ফারুক হাওলাদার। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান থানার কাঁঠালতলী এলাকার শেখ বাড়ি। অপর আসামি শেখ শাহজালাল থাকেন লালবাগের বি.সি. দাস রোডের ৩৮/৫/এ নম্বর বাসায়।
এজাহারে বলা হয়েছে, শেখ শাহজালালের যোগসাজশে রুনা বেগম ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও বোনাসের টাকা তুলেছেন। একপর্যায়ে কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য গত ২৭ মার্চ রুনাকে ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট শাখায় ডাকা হয়। যাচাইয়ে দেখা যায়, তিনি প্রকৃতপক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস আরা বেগমের সন্তান নন। তিনি শেখ শাহজালালের সহায়তায় জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
এ ব্যাপারে শহর সমাজসেবা কার্যালয়-৫-এর সমাজসেবা কর্মকর্তা জহির উদ্দিন সমকালকে বলেন, রুনা বেগম কাউন্সিলরের কাছ থেকে ওয়ারিশান সার্টিফিকেট ও বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুসনদসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দেন। এর ভিত্তিতেই তার ভাতা পাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে। আর এজন্য একটি কমিটি আছে, জেলা প্রশাসকরা সেই কমিটির প্রধান। আগে কখনও এমন জালিয়াতি পাওয়া যায়নি। ফলে ওয়ারিশান সনদ যাচাইয়ের কোনো নির্দেশনা ছিল না। অবশ্য এখন এ ধরনের জালিয়াতির সুযোগ নেই। গত বছর থেকে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তথ্যভান্ডার (এমআইএস) চালু হয়েছে। এখন সহজেই সব তথ্য যাচাই করা যায়।
সমাজসেবা কার্যালয়ের এই কর্মকর্তা আরও জানান, আগে এই কার্যালয়ের অধীনে ৩৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন। এমআইএস চালুর পর যাচাইয়ে ২৮০ জন টিকেছেন।
ওয়ারিশান সার্টিফিকেট ইস্যুর ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৪, ২৫ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক নারী কাউন্সিলর আয়শা মোকাররমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সমাজসেবা কর্মকর্তা বলছেন, কাউন্সিলরের স্বাক্ষর জাল করে সার্টিফিকেটটি তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে।
লালবাগ থানার ওসি এম. এম. মুর্শেদ সমকালকে বলেন, ব্যাংকের পক্ষ থেকে করা মামলাটির তদন্ত চলছে। এই জালিয়াতির পেছনে নানা কারণ দায়ী। অভিযুক্ত শেখ শাহজালালকে এখনও পাওয়া যায়নি। তিনি বাবুবাজার পেপার মার্কেটের যে দোকানের ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অনেক আগেই দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
শেখ শাহজালালের ব্যবহূত মোবাইল ফোন নম্বরটি সচল রয়েছে। তবে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।