উন্নয়ন বৃদ্ধি পেলেও লোকসানের ধাক্কা সামলাতে পারছে না রেল। প্রতিবছর আয়ের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। গত অর্থবছরে রেলের লোকসানের পরিমাণ সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ গত অর্থবছরে আয় হয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ১৩ বছরে রেলে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। আরও প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে।
নতুন রেলপথ, রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ, অত্যাধুনিক লোকোমোটিভসহ ১৪২টি নতুন ট্রেন রেলবহরে যুক্ত হয়েছে। বিদ্যমান ৪৪টি ট্রেনের রুট বর্ধিত করা হয়েছে। এত উন্নয়নের সঙ্গে লোকসানটা কমাতে পারছে না রেল। প্রতিবছরই লোকসানের পালা লাফিয়ে বাড়ছে। ক্রমাগত লোকসানের লাগাম টানতে দুবার ট্রেনের ভাড়া বাড়িয়েও কাজ হয়নি। আবারও ভাড়া বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে রেল। অথচ ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর কোনো সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই।প্রতিদিন আসনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করছেন। এটি রোধের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
রেলপথমন্ত্রী সুজন বলেন, আমরা ক্রমাগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। নতুন ট্রেন, রেলপথসহ ব্যাপক উন্নয়ন করা হচ্ছে। ভাড়া বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি। বিশেষ করে মালামাল পরিবহণে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। তবে, লোকসান কমাতে ভাড়া বাড়ানো হবে কিনা, তা নির্দেশ দেবেন শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় একটি গাড়ি রেলপথে আনা হলে ভাড়া আসছে সাড়ে ৬শ টাকার মতো। আর সড়কপথে ভাড়া পড়ছে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা।রেলওয়ে পরিবহণ ও বাণিজ্যিক দপ্তর সূত্র বলছে, আন্তঃনগর ট্রেনের ক্ষেত্রে গড়ে ৬৯ শতাংশ আসন সংখ্যা অবিক্রীত থেকে যায়। অথচ, এমন কোনো আন্তঃনগর ট্রেন নেই যেগুলোতে আসনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রী চলাচল করছেন না।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশে আন্তঃনগর ট্রেন যখনই উদ্বোধন হয়-সেই সময় ২-৩টি বিরতি থাকে। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে অতিরিক্ত ৭-৮টি স্টেশনে বিরতি দিতে হয়। ১০৫টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে মাত্র ২টি ট্রেন বিরতিহীন চলাচল করে। বর্তমানে ১০৩টি আন্তঃনগর ট্রেন গড়ে ৭ থেকে ১১টি স্টেশনে বিরতি দেয়। মধ্যের স্টেশনগুলোতে আসনসংখ্যা বরাদ্দ থাকলেও মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়। আবার এ সংখ্যক টিকিট মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোতে বিক্রি হলেও পরবর্তী স্টেশনগুলোতে আসনসংখ্যা পুরোপুরিই খালি যায়।
রেলওয়ের হিসাবে কোনো স্টেশনে মেইল, লোকাল বা আন্তঃনগর ট্রেন থামাতে গড়ে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। জ্বালানি, বিভিন্ন পরিকাঠামো, সিগন্যালিংসহ নানা খরচ হয়। বর্তমানে ১২৩টি স্টেশন বন্ধ। এছাড়া নতুন চারটি স্টেশন বছরের পর বছর ধরে বন্ধ। বন্ধ স্টেশনগুলো চালু না করে, কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্টেশনে মেইল ও আন্তঃনগর ট্রেনের লাগাতার বিরতি দেওয়া হচ্ছে। এতে আয় না বেড়ে ব্যয় বাড়ছে।রেল কর্মকর্তাদের বক্তব্য-ট্রেনের বিরতি দেওয়ার সঙ্গে এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের সম্পর্ক থাকতে হয়। তা না হয়ে অধিকাংশ বিরতি হয়েছে-হচ্ছে শুধু রাজনৈতিক প্রভাবে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক জানান, বিশেষ করে গত এক যুগে রেলে উন্নয়ন হচ্ছে বেশ। কিন্তু, এসব উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় এর সুফল মিলছে না। নতুন ট্রেন, নতুন রেলপথ, স্টেশন নির্মাণ হলেও গতি আসছে না। যাত্রী ও মালামাল পরিবহণে কোনো পরিকল্পনা নেই। যত পরিকল্পনা তা হলো-নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। উন্নয়ন হলেও আয় না বেড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যয় বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে বর্তমান অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না।