আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের আগে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সিদ্ধান্ত নিতে চায় বিএনপি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দলীয় সংসদ সদস্যদের জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ। বাকি দুটি সিদ্ধান্ত হলো যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করা এবং নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করে তা জাতির সামনে তুলে ধরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এই তিনটি বিষয় চূড়ান্ত করতে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। এই তিনটি সিদ্ধান্ত নিতে পারলে চলমান আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়া সহজ হবে বলে মনে করছে দলটি।
বর্তমান সংসদে বিএনপির সাতজন এমপি আছেন। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের আছেন চারজন। তাঁদের অন্তত দুজন এরই মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে সংসদ থেকে পদত্যাগ করার আগ্রহ জানিয়েছেন বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
রাজপথে সংসদকে অবৈধ বলে সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হলেও বিএনপির এমপিরা এখনো সংসদে আছেন। এ বিষয়টি সম্প্রতি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছিল। দলের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে আন্দোলনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে পারে। তবে আগে সংসদ সদস্যদের পদত্যাগসহ এই তিনটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না করলে ঢাকা ঘোষণা অর্থবহ হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, আন্দোলনে গতি বাড়াতে সরকারবিরোধী সব দলকে এক প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসার কাজও দ্রুত গুছিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১০ ডিসেম্বরের আগে এগুলো শেষ করার কাজ চলছে।
চলমান রাজনৈতিক ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির অনির্ধারিত বৈঠক হয়। এতে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের এই পর্যায়েও কেন দলের সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করছেন না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কয়েকজন নেতা। বৈঠকে গত সপ্তাহে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে জেলা নেতাদের বৈঠকের সারমর্ম নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। চার দিনব্যাপী ওই বৈঠকে ৯২ জন নেতা বক্তব্য দেন। তাঁদের বক্তব্য থেকে পাওয়া ২২টি বিষয় নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়।
দলীয় এমপিরা এখনো কেন সংসদে
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচ্যসূচির বাইরে বিএনপিদলীয় এমপিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে জেলা নেতাদের বৈঠকেও একই প্রশ্ন উঠেছিল। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কয়েকজনও মনে করেন, এমপিদের সংসদ থেকে পদত্যাগের সময় এসেছে। স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনার এক পর্যায়ে ডিসেম্বরের আগে সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তাতে সম্মতি দেন নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদ অবৈধ দাবি করে সংসদে থাকাটা যুক্তিযুক্ত নয়। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত আসা উচিত। দলের শীর্ষ নেতৃত্বও এ নিয়ে ভাবছেন।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনার সূত্র ধরে বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দল সিদ্ধান্ত দিলে তৎক্ষণাৎ সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে তৈরি আছি। অন্তত আমি তা সঙ্গে সঙ্গে করব।’
দুই রূপরেখা চূড়ান্ত হচ্ছে
বিএনপির স্থায়ী কমিটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য ৯ দফা খসড়া চূড়ান্ত করেছে। দফাগুলো নিয়ে এখন মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। তার ওপর ভিত্তি করে আসবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচি।
এ লক্ষ্যে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্যের উদ্যোক্তারা মিত্র দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করছেন। চলতি মাসের মধ্যে এই আলোচনা শেষ করতে চায় বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। আলোচনা শেষ হলেই দ্রুত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
এদিকে বাতিল হওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর আলোকেই বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে। এক বছর আগে নির্দলীয় সরকারের রূপরেখার ৯ দফা খসড়া চূড়ান্ত করে দলটি। ওই ৯ দফার ভিত্তিতে বাস্তবতার আলোকে রূপরেখা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। গত বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সংবাদ সম্মেলনে এই আলোকে নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন।
১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে বিএনপি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে।
এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের এক নেতা বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ভিত্তি করে নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু পুরোপুরি ত্রয়োদশ সংশোধনী তুলে ধরা হবে না। সংবিধানের ভেতর থেকে কিভাবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব তার কয়েকটি ফর্মুলা দেওয়া হবে। এতে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথ তৈরি হতে পারে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে বিএনপি সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছে।
জেলা নেতাদের বক্তব্যে ২২ বিষয় : বিএনপি নীতিনির্ধারকরা জানান, জেলা পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে আসা ২২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—জাতীয় নির্বাচনে ১০০ কিংবা ১২০ আসনে প্রলুব্ধ না হওয়া, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়, চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখা, যুগপৎ আন্দোলনের নেতৃত্ব বিএনপির হাতে রাখা, নির্যাতিত নেতাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া, রোড মার্চ, লং মার্চ, চলো চলো ঢাকা চল, কর্মিসভা, বাজারসভা, উঠানসভার মতো কর্মসূচি ঘোষণা, বিএনপির সঙ্গে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সমন্বয়, বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপস্থিতি ইত্যাদি।