শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আক্রান্তদের তালিকায় রয়েছে একেবারে শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠরাও।আক্রান্তের পাশাপাশি বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু।
সাধারণত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই চার মাস হল ডেঙ্গুর মূল মৌসুম। চলতি বছরের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এবছর অক্টোবর মাসের শেষে এসেও এতে আক্রান্তের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত ২০ বছরের মধ্যে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার অক্টোবর মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এবছর দেরিতে এসেছে বর্ষা। থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কারণে বাড়ির আনাচে-কানাচে পানি জমে থাকায় এডিস মশার প্রজনন বেশি হয়েছে। ফলে দীর্ঘায়ত হয়েছে ডেঙ্গু মৌসুম।চিকিৎসকরা বলছেন, চলতি বছর ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে তিনটি ধরণ রোগের প্রকোপ বাড়িয়েছে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ায় আক্রান্তদের শক সিন্ড্রোম অর্থাৎ হঠাৎ শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, হেমোরেজিক ফিবার বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে বাড়ছে মৃত্যু। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ৬৪ শতাংশ ডেঙ্গুরোগী মারা যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে সর্বমোট তিন হাজার ২০৭ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ১৮২ জন এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে এক হাজার ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।এবছর ২১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২৯ হাজার ১০৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২০ হাজার ৯০৪ জন এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট আট হাজার ২০৩ জন। এবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার এবারের ডেঙ্গু বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ বছরের অক্টোবর মাসেও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এটি ডেঙ্গু বাড়ার একটি কারণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে, যখন কোনো ভেক্টর বর্ন ডিজিজ বেড়ে যায়, যদি তা দ্রুত থামানো না যায় তাহলে রোগটি বাড়তেই থাকবে। যদি কোনো বাসায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়, তাহলে তাকে মশারির ভেতরে রাখতে হবে, না হয় ওই বাসার সব মশা মেরে ফেলতে হবে। তাহলে ডেঙ্গু রোগী কমে আসবে। আর যদি সেই বাসার মশা মারা না হয়, কিংবা রোগীকে মশারির নিচে না রাখা হয়, তাহলে জ্যামিতিক হারে এই রোগটি ছড়াবে। সেটাই হচ্ছে এবছর।
এডিস মশা আগের চেয়ে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে টাইপ-১, ২, ৩, ৪ । বাংলাদেশের মানুষ ২০০০ সাল থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কোন এক সময় যদি জেনে বা না জেনে কিংবা অজান্তেই টাইপ ওয়ান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, এখন যদি তিনি অন্য আরেকটি ধরন দ্বারা আক্রান্ত হন, তার জন্য ঝুঁকি বেশি এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
তিনি আরও বলেন আগামীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। অনেকদিন ধরে যখন একটা রোগ একটা দেশে সংক্রমণ হয়, আর সেই ভাইরাসের যদি একাধিক ধরন থাকে, সেই রোগটা তখন ভয়াবহ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন তাই হচ্ছে।বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম থাকে। এবারে যেভাবেই হোক না কেন বৃষ্টিপাতের সময়টা বেড়েছে। এ কারণেই অক্টোবর মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। আবার এবছর ডেঙ্গু শুধুই শহর এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই। এবছর ডেঙ্গু শহর থেকে গ্রাম এবং পাহাড়ি এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন ঢাকার পর সব থেকে বেশি কক্সবাজারে।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুর বাহকের দুটি ধরন রয়েছে, একটি আবাসিক ধরন, আরেকটি বুনো বা বন্য ধরন। সাধারণত ডেঙ্গুর আবাসিক ধরন বাহক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যখন কোনো মহামারি হয়, তখন বুনো ধরনটিও বাহকে রূপান্তরিত হয়। এই বুনো ধরনের মশাগুলোর প্রজনন হয় গাছের কোটরে, ডালের মাঝে, ঝোপ ঝাড়ে জমে থাকা পানিতে। আবাসিক এলাকায় মশার ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু নির্মূল হচ্ছে না, কারণ বুনো ধরন থেকেই যাচ্ছে।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, গত বছর পর্যন্ত ডেঙ্গুর ১, ২, ৩ ধরনের সংক্রমণ ছিল, এ বছর ৩ এবং ৪ ধরনের সংক্রমণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। শহরের ডেঙ্গু মশা ইতোমধ্যে তার সংক্রমণের ধরন বদলে ফেলেছে। আগে এডিস মশা শুধু সকালে এবং সন্ধ্যায় কামড় দিত, কিন্তু এখন সারাদিন এডিস মশা কামড়াচ্ছে। যার ফলে এবার শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। যদি আর বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, আর যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে ডেঙ্গু বাড়তেই থাকবে।বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত হচ্ছে, বর্তমানে কোনো জ্বর হলে বিলম্ব না করে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা নিতে হবে। কোনভাবেই কোনো জ্বরকে অবহেলা করা যাবে না। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমানো সম্ভব।