জরুরিভিত্তিতে দরকার মানবিক যুদ্ধবিরতি। ত্রিশ দিন পেরিয়ে গেছে। যথেষ্ট হয়েছে। যুদ্ধ থামাতে হবে এখনই।’ আগ্রাসনের এভাবে এক যৌথবিবৃতিতে গাজায় যুদ্ধবিরতির জোরালো দাবি জানিয়েছেন জাতিসংঘের ১৮টি সংস্থা এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক এনজিওর প্রধান নেতারা।
অবরুদ্ধ উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক হামলায় এরই মধ্যে প্রাণহানি ছাড়িয়েছে ১০ হাজার। আর ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে ১৫ লাখই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত।
গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসকে উৎখাতে ‘সামরিক অভিযান’ নাম দিয়ে মূলত নিরীহ ও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীর ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে দখলদার রাষ্ট্রটি। বিশ্বব্যাপী বহু দেশে অব্যাহত বিক্ষোভ, আরব নেতাদের আহ্বান এবং হামাসের মিত্রদের হুশিয়ারি সত্ত্বেও মানবিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়নি ইসরায়েল। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহত্তর কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গাজায় বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। আল জাজিরার
- এক প্রতিবেদনে গতকালই জানানো হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সাবমেরিন পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যদিয়ে ইসরায়েলের পাশে দৃঢ়ভাবে থাকার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করল ওয়াশিংটন। আরেক প্রতিবেদনে গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক বিল বার্নস ইসরায়েলে সফর করছেন। মিত্রদেশের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতায় আমেরিকার অঙ্গীকার মলিন হবে না, এমন একটি বার্তা দিতে তিনি এই সফর করছেন। গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি থাকা মার্কিন জিম্মিদের উদ্ধারের কৌশল নিয়েও তিনি আলোচনা করতে পারেন বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়। এদিকে, ফ্রান্স জানিয়েছে, জিম্মিদের মধ্যে আট ফরাসি নাগরিক রয়েছেন।
দীর্ঘ ৫৬ বছরের নিপীড়নের বদলা নিতে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। এতে চৌদ্দশর মতো ইসরায়েলি নিহত হন, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। এছাড়া হামাস ২৩৯ জনকে জিম্মি করে, এদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশিজন নিহত হয়েছেন। জিম্মিদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনকে মুক্তি দিয়েছে হামাস।
- হামাসের হামলার বদলা নিতে ওই দিন থেকেই পাল্টা আক্রমণ করছে ইসরায়েল। কিন্তু এতে বেসামরিক মানুষ প্রতিদিন শয়ে শয়ে জীবন হারাচ্ছে। গণহত্যামূলক এই যুদ্ধে অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধও ইসরায়েলি বাহিনী করছে। এর নিন্দা জানিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে। সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকাও একই পথে হেঁটেছে।
- এই যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের প্রসঙ্গ টেনে রবিবারের যৌথবিবৃতিতে জাতিসংঘ ও এনজিও নেতারা বলেছেন, এটা মর্মান্তিক ও ভয়াবহ। এই বিবৃতিতে সইকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন, বিশ্ব খাদ্য প্রকল্প, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের মতো এনজিও।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এক মাস ধরে ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে কী ঘটছে, বিশ্ব তা দেখছে। যেভাবে জীবন ঝরছে, ছিন্নভিন্ন হচ্ছে তা দেখে বিশ্বব্যাপী ধাক্কা খাচ্ছে, সবাই আতঙ্কিত।’ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গাজায় জাতিসংঘের ৮৮ কর্মী নিহত হয়েছেন; একক সংঘাতে সংস্থাটির নিহত কর্মীর সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ।
- তারা সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক মানবিক ও মানবাধিকার আইনের বাধ্যবাধকতাকে সম্মান করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বিশেষত হাসপাতাল ও স্কুলের মতো বেসামরিক অবকাঠামোগুলো রক্ষা করা এবং গাজায় মানবিক ত্রাণ পাঠানোর পথ উন্মুক্ত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজাবাসীকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও পরিসেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, একই সাথে তাদের ঘরবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল ও উপাসনালয়ে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে।
গাজায় মানবিক বিপর্যয় এমন যে, নিহতদের জন্য কান্নার লোকটিও যেন আর নেই। গতকাল আল জাজিরার অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার টেলিযোগাযোগ হরহামেশাই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ি ডাকার সুযোগ না পেয়ে অবশেষে মৃতদেহগুলো গাধার পিঠে করে সরানো হচ্ছে। মানুষের খাবার নেই। তৃষ্ণা নিবারণের জলও নেই। আবার নিরাপদ আশ্রয়ে পালাবার সুযোগও নেই। এমন অসহায় শ^াসরুদ্ধকর সময় পার করছে ফিলিস্তিনিরা।
প্রথমে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা তথা তখন নতুন গড়ে ওঠা ইসরায়েল রাষ্ট্রের কারণে নিজের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয় ফিলিস্তিনিরা। আর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েলি ক্রমবর্ধমান শ^াসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার অবরুদ্ধ গাজাবাসী।
২০০৫ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণভার ছেড়ে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। ২০০৭ সাল থেকে গাজা একটানা শাসন করে আসছে হামাস। আর পশ্চিমতীরে থাকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, যার প্রধান হলেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। হামাসের সঙ্গে আব্বাসের সম্পর্ক ভালো নয়। এমনকি পশ্চিমতীরে তার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন দেখা করতে গেলে, তিনি জানিয়েছেন যে, সংঘাতের সমাধান করতে প্রয়োজনে তিনি গাজার শাসনভার নিতে রাজি আছেন।
যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও হামাসের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে ইরান। অন্যদিকে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত রয়েছে। হিজবুল্লাহও হামাসের মিত্র। রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া বলেছে, তারা মনে করে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনই ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।