ভারতের লাদাখ সীমান্ত এলাকায় ২০২০ এর জুনে চীনা সেনাদের সাথে সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। এই সংঘর্ষ দুই দেশের সম্পর্ককে বহু দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নিয়ে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদী সামরিক উত্তেজনা শুরু করে। এখন ভারত ও চীন একটি আপস চুক্তিতে পৌঁছেছে।
২০২০ এর সহিংসতার পর ভারত স্পষ্ট জানিয়েছে, সীমান্তে আগের অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকবে না। ভারত চীনের প্রতি কঠোর অবস্থানে থাকার যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল, তা প্রমাণ করতে ভারত চীনা বিনিয়োগের অনুমোদন ধীর করে দিয়েছে; চীনা নাগরিকদের ভিসা প্রক্রিয়াকে আরো কঠিন করেছে এবং দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়াও ভারত চীনের প্রশান্ত মহাসাগরের ভূখণ্ডের দাবির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ভারত কিছু এমন রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে যা চীনকে অসন্তুষ্ট করতে পারে।
চীন ও ভারতের সাম্প্রতিক আপস চুক্তি ইঙ্গিত দেয় যে, বেইজিং শেষ পর্যন্ত দিল্লির বার্তাটি বুঝতে পেরেছে। আসলে ভারতের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কৌশল তেমন একটা কাজে আসবে না। তাই ভারতের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কৌশল ছেড়ে দেওয়া উচিত এবং চীনা অর্থ ব্যবহার করে ভারতের নিজস্ব বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণ করা উচিত। যেহেতু রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, তাই এটি কোনো অবাক করা বিষয় নয় যে, ভারতের ব্যবসায়ীরা চীনের সাথে আপসে পৌঁছানোর জন্য মোদি সরকারের উপর চাপ দিচ্ছে।
গত জুলাই মাসে ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সরাসরি এমন একটি কৌশলের পক্ষে কথা বলেন, যা ভারতে চীনা বিনিয়োগ বাড়িয়ে এবং ভারতকে চীনা সাপ্লাই চেইনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করে। গত কয়েক মাসে এমন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যা থেকে মনে হয়েছে, লাদাখে চলমান অচলাবস্থা শেষ করার জন্য একটি চুক্তি হতে চলেছে।
১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মন্তব্য করেন, পূর্ব লাদাখে এলএসি (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) বরাবর চীনের সাথে ‘বিচ্ছিন্নতা’ সমস্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ সমাধান করা হয়েছে। একই দিনে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সেন্ট পিটার্সবার্গে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিশনের পরিচালক ওয়াং ই এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন এই চুক্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তবে আপস-মীমাংসামূলক একটি চুক্তি হলেও এখনও কিছু গুরুতর উদ্বেগ রয়ে গেছে। প্রথমত, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, চুক্তি ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কাজানে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনের পাশের বৈঠকে মিলিত হন, তখন তাদের মন্ত্রণালয়গুলি একেবারে ভিন্ন বিবৃতি প্রকাশ করে। ভারত এই চুক্তিকে ‘বহু মেরুর এশিয়া এবং বহু মেরুর বিশ্বের’ দিকে একটি পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করে, অন্যদিকে চীন এটিকে কেবল ‘বহু মেরুর বিশ্বের’ চুক্তি হিসেবে উল্লেখ করে। চীনের এই কথায় সূক্ষ্ম কিন্তু স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে, এশিয়া চীনের দখলে আছে।
এলএসি বরাবর চীনের কার্যকলাপ স্পষ্টভাবে দেখায় যে, তারা ভারতে অস্থিরতা বজায় রাখতে চায়। তারা সীমান্ত পরিবর্তনের এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে যা চীনের স্বার্থে।
ভুটানের দোকলাম মালভূমি নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে শেষ সংঘর্ষ কীভাবে শেষ হয়েছিল তা আমাদের মনে রাখতে হবে। ভারত দোকলামের মালিকানা দাবি করে না; তবে ভুটানের দাবি সমর্থন করে। ভুটানের এই দাবিকে চীন আবার প্রত্যাখ্যান করে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় মহাসড়ক দোকলাম মালভূমির নিচ দিয়ে চলে গেছে। এই মহাসড়ক ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিকে দেশের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করেছে। তাই যখন চীন দোকলামে একটি চীনা মহাসড়ক নির্মাণের জন্য সেনা স্থাপন করেছিল, তখন ভারত সেনা পাঠিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল।
সর্বশেষ সই করা লাদাখ চুক্তির মতো সেই সময় দোকলাম সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দুই পক্ষ কয়েক মাসের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছিল। এরপর চীনা সেনাবাহিনী দোকলামের অন্য স্থানে সড়ক নির্মাণ করে। বর্তমানে চীনা সেনারা সেখান থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় সড়কের ওপর নজর রাখে। আসলে চীন একটি নির্দিষ্ট কৌশল অনুসরণ করে নিজেদের সীমানা বাড়ানোর কাজ করে থাকে।