১৬ বছরের ছেলে সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি মা–বাবার। পরদিন ছেলে মারা গেল। স্বজনেরা লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে জানতে পারলেন, থানায় হত্যা মামলা হয়ে গেছে। কিন্তু পরিবার কিছুই জানে না।
পরিবার ও এলাকাবাসী বলছে, আসল খুনিদের বাঁচাতে ও নিরীহ লোকদের ফাঁসাতে কেউ মামলাটি করতে পারে। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর মা–বাবা ও ভাইকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় পুলিশ। ফেরার পর থেকে তাঁরা আর কিছু বলছেন না।
নিহত কিশোরের নাম মো. জায়দুল ইসলাম। তার বাবা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ শহরের দত্তপাড়ার রফিকুল ইসলাম। সে পড়ত উপজেলা শহরের শিমুলতলা মোড়ের প্রতিশ্রুতি মডেল হাইস্কুলে। জায়দুল গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিল। আবার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য টেস্ট পরীক্ষা দিচ্ছিল।
ঘটনার শুরু গত মঙ্গলবার সকালে। জায়দুলের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা ছিল সেদিন। রিকশায় করে স্কুলে যাচ্ছিল পরীক্ষা দিতে। পথে উপজেলা মৎস্য খামারের কাছে ছয়-সাতজনের একটি দল রিকশাটি থামায়। তারা ছেলেটিকে রিকশা থেকে নামিয়ে গলায় ছুরিকাঘাত করে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হয়ে তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে মারা যায় সে।
জায়দুলের বাবা রফিকুল ইসলাম বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কেন তাকে মেরে ফেলা হলো, বুঝতে পারছি না।’ তবে প্রতিশ্রুতি মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শোয়েব মোহাম্মদ বলেন, মহল্লার কিছু ছেলের সঙ্গে জায়দুলের ঝামেলা চলছিল। বিষয়টি সে তাঁকে ফোনে জানিয়েছিল।
মামলা হলো, পরিবার কিছুই জানল না?
সংকটাপন্ন অবস্থায় জায়দুলকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় নিয়ে যায় পরিবার। সঙ্গে ছিলেন মা নুরেজা পারভীন, ভাই তারেকুল ইসলামসহ কয়েকজন। বুধবার দুপুরে লাশ নিয়ে তাঁরা বাড়িতে ফেরেন। অথচ ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মামলা রেকর্ডের সময় দেখানো হয়েছে ১৬ অক্টোবর রাত ১২টা ৫ মিনিট। এজাহারে বাদীর নাম রয়েছে ‘জায়দুলের মা মোছা. নুরজাহান’।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জায়দুলের বাড়িতে যান সাংবাদিকেরা। মা নুরেজা পারভীন বলেন, ছেলের চিকিৎসা নিয়েই তিনিসহ স্বজনেরা ব্যস্ত ছিলেন। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা দত্তপাড়ার বাড়িতে ফেরেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বা পরিবারের কেউ থানায় যাননি। থানা থেকেও কেউ বাড়িতে আসেননি। মামলার এজাহারটি দেখালে নুরেজা বারবার বলতে থাকেন, ‘আমি মামলা করার জন্য থানায় যাইনি। থানা থেকে পুলিশের কেউ আমার কাছে আসেনি।’ বাবা রফিকুলও একই কথা বলেন। তাঁর ভাষ্য, তাঁর স্ত্রী ঘটনার পর থেকে পুত্রশোকে কাতর। তিনি কখনো থানায় যাননি। কীভাবে মামলা হয়েছে, তা তাঁরা জানেন না।
এখন সবাই চুপ
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিভিন্ন মহলে তোলপাড় শুরু হয়। খবর যায় ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ আবিদ হোসেনের কাছে। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈশ্বরগঞ্জ থানা থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, নিহতের মা মামলা দায়ের করেছেন।’ এই প্রতিবেদক এসপির কাছে জানতে চান, মামলা রেকর্ড করার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সময় নিহতের মা ঈশ্বরগঞ্জে ছিলেন না। তাহলে তিনি কীভাবে মামলা করলেন। জবাবে এসপি বলেন, ‘আমি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’
বৃহস্পতিবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈশ্বরগঞ্জ থানা থেকে একদল পুলিশ জায়দুলদের বাড়িতে গিয়েছিল। তারা জায়দুলের মা-বাবা ও বড় ভাই তারেকুল ইসলামকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে গেছে। সন্ধ্যার দিকে অবশ্য তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহম্মেদ কবীর হোসেন বলেন, মামলা নিয়ে কে বা কারা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করেছে। এ বিষয়ে জানতে তাঁদের ডাকা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জায়দুল আহত হওয়ার পর তাঁর মা থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগ দিয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। ওই অভিযোগটিই আদালতের অনুমতি নিয়ে ৩০২ ধারার (হত্যার অভিযোগ) মামলায় রূপান্তর করেছে পুলিশ। মামলায় বাদীর নাম দেখানো হয়েছে ‘নুর জাহান’। কিন্তু জায়দুলের মায়ের নাম তো নুরেজা পারভীন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ আবিদ হোসেন বলেন, নুরেজা পারভীনেরই ডাকনাম নুরজাহান।
তবে মামলার বিষয়ে ওসি আহম্মেদ কবীর হোসেন গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, বাদীর পক্ষ থেকে বুধবার রাতে এক ব্যক্তি থানায় এসে এজাহার দিয়ে যান।
গতকাল বিকেলে জায়দুলের বড় ভাই তারেকুল ইসলামকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলেন, ‘আমি ভাই হত্যার বিচার চাই।’ মামলা সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে চাননি।