রাজধানীর প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল। সেখানে রয়েছে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর। এসব দপ্তরে বছরে শত শত কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়। তাই মতিঝিল যার দখলে তিনি যেন এক ‘মধুর হাঁড়ি’র মালিক। এর বাইরে মতিঝিল ও আরামবাগেই রয়েছে ৮টি নামিদামি ক্লাব। দীর্ঘদিন ধরে এসব ক্লাবে ক্যাসিনো কারবার খুলে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই মতিঝিল ও আশপাশ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন। মতিঝিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় প্রতিযোগিতা থাকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মধ্যে। শুদ্ধি অভিযানে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, এনামুল হক আরমানসহ অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মতিঝিলপাড়ায় অপরাধ সাম্রাজ্য এখন ফাঁকা। আবার এ এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী অনেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে আছেন। এই সুযোগে ফাঁকা সাম্রাজ্য দখলে নতুন তৎপরতা শুরু হয়েছে। দেশে-বিদেশে পলাতক অনেকে নতুনভাবে তাদের লোক সামনে এনে সাম্রাজ্য দখলের মাধ্যমে টাকা কামানোর চেষ্টায় মগ্ন। এরই মধ্যে কানাডা থেকে সোহাগ নামে একজন ফোন করে তার লোকজনকে দেখে রাখতে পুলিশ কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তবে কে এই সোহাগ এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে মতিঝিল ও আশপাশ এলাকা যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাদের অনুপস্থিতিতে যাতে অন্য কেউ সেই জায়গা দখল করতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ রয়েছে প্রশাসন। অনেক সময় নতুন দখলদারিত্ব কায়েম করতে গিয়ে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে। সেটা যাতে না হয় সে ব্যাপারে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৌগোলিক কারণে মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও রামপুরা এলাকা সন্ত্রাসপ্রবণ। এক সময় এ এলাকার একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন কাইল্যা পলাশ, ঘাতক স্বপন ও শাহজাদা। এসব সন্ত্রাসীর পাশাপাশি যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল সেই দলের কিছু অসাধু লোকজন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন। মূলত জমি-জমার ব্যবসা, ফুটপাতে দোকান, জুট ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণই তাদের প্রধান কারবার। এক সময় শাহজাহানপুর ও মতিঝিল এলাকার একক আধিপত্য ছিল মির্জা আব্বাসের। পরে মির্জা আব্বাসকে হটিয়ে ওই সাম্রাজ্যের দখল নেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। মতিঝিল এলাকার দখল নিয়ে যুবলীগ নেতা মিল্ক্কী ও মোছা বাবু হত্যার ঘটনা ঘটে। মূলত মোছা বাবু হত্যার মধ্য দিয়ে মতিঝিল ও এজিবি কলোনির অপরাধ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক একটি বড় চক্রকে আইনের আওতায় নেওয়া হয়।
কীভাবে চলত ক্লাব: জানা গেছে মতিঝিল, আরামবাগ ও আশপাশ এলাকার ক্লাবগুলোর আয়ের একটি বড় জায়গা ছিল ক্যাসিনো কারবার। ফকিরাপুল ইয়ংম্যানস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ নেতা সাব্বির হোসেন। ওই ক্লাবের চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা, সাধারণ সম্পাদক মানিক মিয়া। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি একজন শিল্পপতি, সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাইদ ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান। আরামবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি কাউন্সিলর মমিনুল হক সাইদ ও সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি সাবেক কাউন্সিলর নেছার আহম্মদ কাজল ও সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তুহিন। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল ও সাধারণ সম্পাদক একজন যুবলীগ নেতা। সৈনিক ক্লাবের সভাপতি মোতাহার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, নিপুণ, ১-১০, ১-৮, চড়চড়ি নামে ইনডোর গেমের আড়ালে ক্যাসিনোর কারবার চালিয়ে আসছিল অধিকাংশ ক্লাব। কখনও কখনও অভিযানে গেলে আইনি কাগজপত্র দেখিয়ে তাতে বাধাগ্রস্ত করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তবে এই সুযোগে বিভিন্ন সেক্টরের অসাধু লোকজন ক্যাসিনো থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার চাঁদা নিত।
সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। এরপর তাকে সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়। খালেদ ও তার ক্যাডার বাহিনী দীর্ঘ দিন মতিঝিল পাড়ায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল। খিলগাঁও-শাহজাহানপুর হয়ে চলাচলকারী গণপরিবহন থেকে নিয়মিত টাকা দিতে হতো খালেদকে। কোরবানির ঈদে শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদ। সরকারি দপ্তরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা আলাদা ক্যাডার বাহিনী ছিল। রাজউকেও টেন্ডারে প্রায় নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। রেল ভবনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদের ভাই মাসুদ। রাজউক ভবনের নিয়ন্ত্রণে ছিল খায়রুল ও উজ্জ্বল। খালেদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। খালেদ, সম্রাট ও আরমান গ্রেপ্তারের পর পুরো সাম্রাজ্য এখন শূন্য। এই সুযোগে সাম্রাজ্য দখলে শুরু হয় নতুন তৎপরতা। এরই মধ্যে সম্রাট ও খালেদ জিজ্ঞাসাবাদেও দিয়েছেন অনেক তথ্য। স্থানীয় সাংসদ, রাজনীতিক ও অন্যান্য সংস্থার লোকজন মিলেমিশেই ক্যাসিনো থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ভাগিয়ে নিয়ে আসছিলেন। ক্যাসিনোর সুবিধাভোগীর তালিকা বেশ দীর্ঘ।
সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, ক্যাসিনো, টেন্ডার থেকে সুবিধাভোগী যাদের নাম বেরিয়ে আসছে তাদের ব্যাপারে আরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। দেশে-বিদেশে তাদের নামে-বেনামে সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করছে একাধিক সংস্থা। বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন পিন্টুর এক আত্মীয়র মাধ্যমে যুবলীগের বহিস্কৃত নেতা খালেদ কানাডায় টাকা পাঠিয়েছেন কি-না, তাও যাচাই করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, খালেদের নাম ভাঙিয়ে ঢাকার বাইরেও কয়েকজন লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার একজন চেয়ারম্যানের ব্যাপারেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।