দ্রুততম সময়ের মধ্যে মানব পাচার বিষয়ক বিশেষ আদালতে বিচারক নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসাইন।
তিনি বলেছেন, বিদ্যমান আইনের আলোকে বিশেষ শিশু আদালত গঠনের কাজ চলছে। আদালত গঠনের কাজ শেষ হলে আমি দ্রুততম সময়ে মধ্যে বিচারক নিয়োগ দিব। এতে শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে শুরু হওয়া শিশু পাচার বিষয়ক আন্তসীমান্ত সমন্বয় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন।
ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলীর সভাপতিত্বে বক্তৃতা করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফেরদৌসি আক্তার, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শিব নাথ রায়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় যুগ্ম সচিব গাজীউদ্দিন মুহাম্মদ মুনির, ভারতের বেসরকারী সংস্থা এসএলএআরটিসি’র প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নাথ মণ্ডল, এ্যাটসেক’র দিল্লি সমন্বয়ক রমা দেবব্রত, প্ল্যান বাংলাদেশের ওরলা মুরফি, আইওএম-এর বাংলাদেশ প্রধান গিওরগি গিয়ারগিয়া, জাতীয় শিশুশ্রম মনিটারিং কমিটির কো-চেয়ার অ্যাডভোকেট সামলা আলী, টিডিএইচ নেদারল্যান্ডস-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মাহমুদুল কবীর প্রমুখ।
সভায় প্রধান বিচারপতি বলেন, মানব পাচার এক ধরনের সহিংসতা। নারী ও শিশুরা সব থেকে বেশি এই সহিংসতার শিকার হয়। তাদেরকে পাচার করে নিয়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগানো হয়। এমনকি অসামাজিক ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন।
দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় পাচার সংক্রান্ত মামলা বিচারধীন সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশে বিচারক স্বল্পতা আছে। আবার বিচারকরাও অনেক সময় সাক্ষী পান না। সাক্ষীরা আদালতে আসতে চান না। সমন জারির দায়িত্ব আদালতের। কিন্তু সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। তবে আমি নির্দেশনা দিয়েছি রাত ১০টায়ও যদি সাক্ষী হাজির হয়, তার সাক্ষ্য নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে ১০ লাখের বিপরীতে একজন বিচারক আছেন। ভারতে আছে ১৮জন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১২৭ জন। আর বাংলাদেশে যেখানে ৮৫ শতাংশ মামলা আদালতে যায়, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১৫ শতাংশ মামলা আদালতে যায়। ফলে মামলার বিচার শেষ হতে সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। সাক্ষ্য ও তথ্য প্রমাণের অভাবের কারণে বেশীরভাগ মামলায় সাজা হয় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে অতিরিক্ত সচিব ফেরদৌসি আক্তার বলেন, কোন একক দেশের পক্ষে মানব পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন আঞ্চলিক পর্যায়ে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বিশাল সীমান্ত এলাকায় ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষে বিশেষ যৌথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ভারতের প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নাথ মণ্ডল বলেন, পাচারের শিকার হওয়া ৪০ থেকে ৫০ জন শিশুকে প্রতিবছর আমরা ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠিয়ে থাকি। কিন্তু এক্ষেত্রে আইনী নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। তাই সুনির্দিষ্ট আইনের পাশাপাশি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো দরকার। এক্ষেত্রে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রয়োজন।
সরকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে করেন অতিরিক্ত সচিব শিব নাথ রায়। তিনি বলেন, মানব পাচার বন্ধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো অনেক কাজ করছে। কিন্তু সেখানে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একইভাবে ভারত ও বাংলাদেশ আঞ্চলিক পর্যায়ে পরিচালিত কার্যক্রমেও সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। এ সকল বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
সরকারের যুগ্ম সচিব গাজীউদ্দিন মুহাম্মদ মুনির বলেন, শিশুসহ মানবপাচার বন্ধে নতুন নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্র, মহিলা ও শিশু এবং আইন মন্ত্রণালয়সহ সরকার কাজ করছে। যে কারণে পাচার আগের থেকেও কমে এসেছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে আঞ্চলিক পর্যায়ের এ ধরনের উদ্যোগ আরো ইতিবাচক ফল দিবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মানব পাচার বন্ধে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, দেশে আইনের অভাব নেই। কর্মপরিকল্পনায় গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হতাশাজনক। আঞ্চলিক পর্যায়ে মনিটারিং কমিটি গঠন করা হলেও সভা হয় না। পাচার শিকার শিশুরা আইনী সুরক্ষা পায় না। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত মূল হোতারা পার পেয়ে যায়। এই অবস্থার থেকে উত্তরণে অন্যান্য দেশগুলোর ভালো প্রাকটিসগুলো অনুসরণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।