এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় সিন্ডিকেট আরিচা ঘাটকে মাদক পাচারের নিরাপদ ট্রানজিট রুটে পরিণত করেছে। প্রতি মাসেই এ সিন্ডিকেট শত কোটি টাকার মাদক পাচার করে এর কমিশন বাবদ হাতিয়ে নিচ্ছে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে আনা মরণনেশা ইয়াবার চালানগুলো পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও কুষ্টিয়া জেলার ৯টি পয়েন্টে।
একই সিন্ডিকেট কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর সীমান্ত পেরিয়ে আসা ভারতীয় ফেনসিডিল ও গাঁজার চালান এনে পৌঁছে দিচ্ছে রাজধানীর গাবতলী এলাকায়। অস্ত্রধারী যুবকদের পাহারায় মাদকের এসব চালান আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে সিন্ডিকেটের নিজস্ব স্পিডবোট। মাদকের এ ট্রানজিট রুটের সুবিধা নিশ্চিত করতেই এমপি দুর্জয় আরিচা ঘাটে অবৈধ স্পিডবোট চালুর ব্যবস্থা করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নিজের ঘনিষ্ঠ লোকজনের মালিকানাধীন স্পিডবোটগুলোই এ সিন্ডিকেটের আওতায় মাদক পাচারে তৎপর থাকছে।আরিচা ঘাট এলাকায় স্পিডবোটের মাধ্যমে মাদক পাচারের বিষয়টি দেখভাল করে থাকে দুর্জয় এমপির বিশ্বস্ত সহযোগী শিবালয় থানা ছাত্রলীগ সভাপতির নেতৃত্বে ২০-২২ জন নেতা-কর্মী। অন্যদিকে জনির প্রধান সহচর অনির তত্ত্বাবধানে থাকে মাদকের মূল গুদামখানা। শিবালয় থানার অদূরেই মোহামেডান ইয়ুথ ক্লাবের পরিত্যক্ত ভবনটি ছাত্রলীগের মাধ্যমে জবরদখল করে মাদকের গুদাম বানানো হয়েছে। এ ভবনটি ঘিরে অন্তত ১০ জনের অস্ত্রধারী গ্রুপ রাত-দিন পাহারা দেয়। সিন্ডিকেটের লোক ছাড়া সাধারণ কারও ওই গুদামের আশপাশে যাওয়াও নিষিদ্ধ।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, প্রতিদিনই এ ট্রানজিট রুট ও স্পিডবোট ব্যবহার করে কমবেশি মাদক আনা-নেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে সপ্তাহের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে ৮-১০ লাখ পিস ইয়াবার চালানও পাঠানো হয়, তেমনি বিপরীত দিক থেকে ফেনসিডিলও আসে হাজার হাজার বোতল। গাঁজার চালান আসে বস্তায় বস্তায়। স্পিডবোট পরিচালনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রটি জানায়, বেড়া কাজীরহাট ঘাটে ইয়াবার বড় চালানটি যায় ছোবহান সিন্ডিকেটের নামে। সাঁথিয়া থানা এলাকার শীর্ষ মাদক সিন্ডিকেট ছোবহানের সহযোগীরা পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে হাজার হাজার ইয়াবা সরবরাহ করে থাকে।
একইভাবে রাজবাড়ীর চর এলাকায় প্রিন্স গ্রুপের কাছে এবং দৌলতদিয়া ঘাটে তমছের আলী গ্রুপের কাছে ইয়াবার চালান পৌঁছানো হয়। এদের মধ্যে রাজবাড়ীর মাদকসম্রাট নাজমুল হাসান প্রিন্স গ্রুপ আরিচার ট্রানজিট পয়েন্টের স্পিডবোটের মাধ্যমে সপ্তাহে ১০-১২ লাখ পিস ইয়াবার সরবরাহ নিয়ে থাকে।অন্যদিকে কাজীরহাট ঘাট হয়ে ছোবহান সিন্ডিকেটের কাছে এক দিন পর পর আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ পিস ইয়াবার চালান পৌঁছানো হয় বলে সূত্রটি দাবি করেছে। স্পিডবোটে হরদম ইয়াবার বড় বড় চালান সরবরাহের ব্যাপারে পুলিশের কোনো নজরদারি চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে নৌপুলিশের আরিচা ঘাট ফাঁড়ির এক কর্মকর্তা হাতজোড় করে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের হ্যাঁ-না কোনো বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশ করবেন না প্লিজ।’ একই ফাঁড়ির আরেক কর্মকর্তা অব দ্য রেকর্ডে বলেন, ‘এমপি সাহেব (দুর্জয়) পরিচালিত স্পিডবোটগুলোর ব্যাপারেও রিভার পুলিশের নজরদারি চলছিল। সন্দেহভাজন বোট মাঝনদীতে থামিয়েও তল্লাশি শুরু হয়। কিন্তু জেলার এক পুলিশ কর্মকর্তার ধমকে স্পিডবোটের দিকে তাকানোটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
’ট্রানজিট রুট সচল রাখাসহ মাদক পাচার ও বাজারজাতের পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি দুর্জয়ের বহুল আলোচিত তিন খলিফা। তারা হচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের সদস্য আবুল বাশার, মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাক রাজা এবং দুর্জয়ের চাচাতো ভাই ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান জনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ঘোষিত তালিকাতেও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের শেল্টারদাতা হিসেবে বাশার ও রাজার নাম-ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মানিকগঞ্জ জেলার ১৪২ জনের বিরুদ্ধে মাদকের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনসহ তিন মন্ত্রণালয়ের জরিপ রিপোর্ট ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মাদক-বাণিজ্য পরিচালনাসহ সন্ত্রাসী লালন-পালনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী হিসেবে জেলার ১৪ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির যে তালিকা রয়েছে, এর মধ্যে ২ নম্বর তালিকায় আছে আবদুর রাজ্জাক রাজা এবং ৩ নম্বর তালিকায় রয়েছে আবুল বাশারের নাম।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে দুর্জয়ের কিসের ঘনিষ্ঠতা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।
মাদকের তিন গডফাদার মাহবুবুর রহমান জনি, আবুল বাশার এবং আবদুর রাজ্জাক রাজা ছাড়াও মানিকগঞ্জে এমপি দুর্জয়ের পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত অনেক নেতা-কর্মীই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন।
এ ক্ষেত্রে এমপির সরাসরি প্রশ্রয় থাকে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তেওতা ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করিম শেখ, স্ত্রী-সন্তানসহ ৬০০ পিস ইয়াবা নিয়ে গ্রেফতার হন। পরে দুর্জয় সরাসরি শিবালয় থানার ওসিকে ফোন করে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। শিবালয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুসের ছেলে মিম ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সেলিম রেজাও মাদকের ডিলার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। অথচ তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী করেই চলাফেরা করেন এমপি দুর্জয়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ‘এমপি দুর্জয় যখন নির্বাচনী এলাকায় যান তখন মানিকগঞ্জ শহর থেকেই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা মোটরসাইকেল বহর নিয়ে হাজির হন। তাদের উগ্রতা আর বেপরোয়া বিচরণে সাধারণ মানুষের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যে কারণে এমপি সাহেবের উপস্থিতির কোনো মিটিং-মিছিলে আমরা কাক্সিক্ষত লোকসমাগম ঘটাতে ব্যর্থ হই।’
শিবালয় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আলী আহসান মিঠু, তিনি শিবালয় উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। শুরু থেকেই তিনি ছিলেন এমপি দুর্জয়ের ঘোর বিরোধী। তবে মাত্র দুই মাস আগে মিঠুর সঙ্গে এমপির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সমঝোতা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আরিচা ঘাটের স্পিডবোট বাণিজ্য, মাদক-বাণিজ্য ও বালু-বাণিজ্যের একটি অংশ তাকে দেওয়ার বিনিময়ে এ সমঝোতা হয়। এর পর থেকেই আরিচা ঘাটে দুর্জয় এমপির ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে যাবতীয় অপরাধ-অপকর্ম সবকিছুর নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন মিঠু।