পুলিশ বাহিনীকে জনগণের বন্ধু ও প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ প্রশাসন গড়ে তুলতে অসৎ ও মাদকসেবী পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরি চলছে। সমগ্র বাহিনীকে ইমেজ সঙ্কটে ফেলবে এমন পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন মেনে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। একই সঙ্গে নতুন বছরে পুলিশ বাহিনীকে রোল মডেল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত প্রায় ছয় মাস আগে ৩১ জুলাই রাতে চট্টগ্রামের কক্সবাজারে মেজর (অব) সিনহা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এর দুইদিন পর সিলেটে আরও একটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এরপর গত ছয় মাসে দেশে আর কোন বন্দুকযুদ্ধে কাউকে প্রাণ দিতে হয়নি। দেশের কোথাও যাতে আর কোন বন্দুকযুদ্ধ না ঘটে এবং বন্দুকযুদ্ধ এড়িয়ে চলা হয় সেজন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। যদিও আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে পুলিশ সদর দফতরের দাবি।
কর্মকর্তা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছা করে বন্দুকযুদ্ধ ঘটায় না। নিজের ওপর আক্রমণ হলেই কেবল গুলি চালিয়েছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই বন্দুকযুদ্ধের মতো কোন ঘটনা ঘটছে না। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। সেগুলো শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। আর ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠানের ওপর কখনও পড়ে না। যারাই অপরাধ করুক না কেন আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান।
পুলিশ সদর দফতর দাবি করছে, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন মেনে চলতে পুলিশকে নতুন দিক নির্দেশনা দেওয়ার ফলে বিদেশে ইতোমধ্যেই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। বিদেশী দাতা সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন মেনে চলার বার্তা পৌঁছাচ্ছে।
জনগণের পুলিশ, জনগণকে সেবা করার কর্তব্য, জনগণকে ভালবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা এসব বাণী নিয়ে নতুন বছরে অগ্রসর হচ্ছে পুলিশ বাহিনী।
পুলিশ সদর দফতর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অসহায়, বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। পুলিশ দেখে মানুষ যেন ভয় না করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুলিশ দেখে জনগণের মাঝে এমনভাবে কাজ করতে হবে যেমন বিশ্বাস, আস্থা, শ্রদ্ধার মনোভাব জন্মায়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদেরও সেভাবে গড়ে উঠতে হবে। জনগণের বন্ধু হয়ে জনগনকে সঙ্গে করে অপরাধ দমনে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সময়ে বিপদগ্রস্ত ও গৃহবন্দী মানুষজনের পাশে দাঁড়িয়ে ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস অর্জন আরও করে মানবিক উপাধি পেয়েছে পুলিশ। করোনাভাইরাসের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অন্তত ৮২ পুলিশের মৃত্যু ঘটেছে এবং গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন আরও পুলিশ বাহিনীর ১৮ হাজার সদস্য। এমনও দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার পর আবারও মানবিক সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। একই মনোভাব নিয়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পুলিশকে বলা হয় সাধারণ মানুষের বন্ধু। বাংলাদেশে মানুষ বিপদে না পড়লে পুলিশের কাছে যেতে চায় না। বাধ্য হয়ে গেলেও মনের মধ্যে শঙ্কা কাজ করে। বিপদে পড়ে পুলিশের কাছে গিয়ে মানুষ আরও ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। কখনও কখনও পুলিশের আইনের মারপ্যাঁচে নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হয়। এমনকি রাস্তায় চেকপোস্টে পকেটে মাদক দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানির অনেক নজির রয়েছে। এছাড়া ঘুষ, দুর্নীতি ও মাদক গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।
পুলিশ সদর দফতর থেকে বলা হচ্ছে, এসব অভিযোগ গোটা পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়। কতিপয় অসাধু পুলিশ সদস্যের কারণে গোটা বাহিনীর বদনাম হয়। পুলিশের এই বদনাম ঘুচানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কঠোরভাবে আইন মেনে কাজ করার নির্দেশে দেয়ার পাশাপাশি জোরদার মানিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অসৎ পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে জিরো টলারেন্স। কোন পুলিশ সদস্য এ ধরনের অপরাধে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন এখন চায়, পুলিশ মানুষের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠুক। মানুষ যেন নির্ভয়ে পুলিশের কাছে যায় তেমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি হোক। যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আসতে পারবে না তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীর দুই লাখের বেশি সদস্যের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর হাতে গোনা কিছু সদস্য বিপথগামী। দুর্নীতি, মাদক সেবী, অসৎ কাজে লিপ্ত পুলিশ বাহিনীর এসব সদস্যের কারণে যাতে পুলিশ বাহিনীর ইমেজ সঙ্কট না হয় সেজন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপরও ঘটছে বিচ্ছিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত ঘটনা।
বরিশালে পুলিশ হেফাজতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী রেজাউল করিম রেজা নিহত, নারায়ণগঞ্জে তিন আসামিকে নির্মম নির্যাতন করে পুলিশের মিথ্যা জবানবন্দী আদায়ের ঘটনা এবং বিচারিক তদন্তে ধর্ষণের পর খুন হওয়া কিশোরীর জীবিত ফিরে আসার মতো ঘটনায় পুলিশ বাহিনীতে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছাচ্ছে। বরিশালে গোয়েন্দা পুলিশের নির্যাতনে রেজাউল করিম রেজা নামে শিক্ষানবিশ আইনজীবীর মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটার পর তিন পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে পিবিআইকে। এই ধরনের ঘটনার পর অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। যেসব পুলিশ কর্মকর্তার নেতিবাচক আচরণে আজ নানাভাবে পুলিশ প্রশ্নবিদ্ধ তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে মৃত মেয়ের ফিরে আসা অন্যতম। মারধর করে ভয় দেখিয়ে আসামিদের কাছ থেকে পুলিশের স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে বিচারিক প্রতিবেদনে।
পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ প্রশাসন। আদালতও বলেছে, এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যাতে গোটা বাহিনীকে জড়িয়ে ফেলা না হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সদস্যদের জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সম্প্রতি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারদায় ৩৭তম বিসিএস-পুলিশ ব্যাচের শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি এ নির্দেশ দেন।
এর আগে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, পুলিশ প্রশাসনে অসৎ, অদক্ষ পুলিশ কর্মকতা চাই না। নিয়মিত জ্ঞান চর্চা ও নিজেকে তৈরি করার মাধ্যমে উন্নত দেশের উপযোগী পুলিশ হতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা পুলিশে পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাই। এমন পুলিশ কর্মকর্তা চাই যারা দেশের জন্য, সমাজের জন্য পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। জনগণকে সেবা দিতে পারবে। জনগণের পুলিশ হয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, সমাজের জন্য কাজ করতে পারবে। বাংলাদেশ পুলিশ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে অত্যন্ত সাফল্য অর্জন করেছে যা দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশের প্রচলিত আইন শতভাগ অনুসরণ করে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের। কোন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কোন অপরাধীর সম্পর্ক থাকলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন শতভাগ অনুসরণ করলে পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। কোন পুলিশ সদস্যের আচরণগত কারণে যেন পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।