বগুড়ায় বিষাক্ত মদ ট্র্যাজেডির অন্যতম হোতা পারুল হোমিও হলের মালিকদের একজন বিএনপি নেতা নুর মোহাম্মদ (৫২)। দেড় যুগ আগেও তিনি ছিলেন সাধারণ হোমিও ব্যবসায়ী। পাশাপাশি ঠিকাদারি ব্যবসাতেও মনোযোগী হন তিনি। সময়ের ব্যবধানে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। ব্যবসা করছেন চীনা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলছেন হোমিও ল্যাবরেটরির প্ল্যান্ট। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ধনকুবেরদের দেশ দুবাইয়ে প্রসারিত তার চারণক্ষেত্র।
নুর মোহাম্মদের নানা ডা. কছির উদ্দিন ছিলেন নামকরা হোমিও চিকিৎসক। তার মেয়ে নুরুন্নাহার বেগম পারুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হোমিও চিকিৎসাকেন্দ্রের নাম ‘পারুল হোমিও হল’। নানার পরিচিতি পুঁজি করে এক সময় দুই যমজ ভাই নুর আলম ও নূরনবীর সঙ্গে (৫৮) হোমিও ব্যবসায় নামেন নুর মোহাম্মদও।
বি.কম পাস করার পর তিন ভাই হোমিও চিকিৎসকের ডিগ্রি নেন। মায়ের নামের প্রতিষ্ঠানটির জন্য বিভিন্ন সময় সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তারা। তবে এখন তিন ভাইয়েরই আলাদা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
নুর মোহাম্মদের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ইউনিসন হোমিও’। নুরে আলমের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘পুনম হোমিও’ এবং আরেক ভাই নূরনবী পরিচালনা করছেন মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘পারুল হোমিও’।
বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় রয়েছে পারুল হোমিও হলের বিশাল ল্যাবসহ কারখানা। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও সেখানে উৎপাদিত কোটি কোটি বোতল হোমিও ওষুধ চলে যেত খুলনা, যশোর, পাবনা ও বরিশালে। পারুল হোমিও হলের একটি সুনাম ছিল দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু পরে সেই সুনাম পুঁজি করেই অনৈতিক ব্যবসায় নামেন তিন ভাই।
বগুড়ায় রেকটিফাইড স্পিরিট ট্র্যাজেডিতে ১৬ জন মারা যাওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) ভোররাতে নূরনবীসহ আরও চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল দিনভর অভিযান চালায় ফুলবাড়ি এলাকায় অবস্থিত পারুল হোমিও হলের ল্যাবরেটরিতে। সেখানে অত্যাধুনিক বিদেশি যন্ত্রপাতি ছাড়াও ওষুধ তৈরির সামগ্রী পাওয়া যায়। সেখানে হোমিও ওষুধের নামে বিষাক্ত মদ তৈরির মালামালও পায় পুলিশ। পারুলের এই ল্যাবে রেকটিফাইড স্পিরিট থেকে উৎপাদিত অবৈধ মদ বগুড়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পারুল হোমিওতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন ছোট ভাই নুর মোহাম্মদ। তিনি বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। কথিত আছে, বগুড়ার প্রভাবশালী এই বিএনপি নেতার পদচারণা ছিল হাওয়া ভবন পর্যন্ত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তারেক রহমানের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে তাকে। কিন্তু রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে ২০০৫ সালের দিকে নুর মোহাম্মদ দল থেকে বহিষ্কৃত হন।
রাজনীতির মাঠে খেই হারিয়ে হোমিও ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি দফতরের ঠিকাদারিতে মনোযোগী হন। তখন হোমিও ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব নেন অন্য দুই ভাই। কিন্তু অবৈধ বাংলা মদ বিক্রির অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেফতার হন তিন ভাই। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে মামলা করা হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জামিনে মুক্ত হন।
এরপর বড় দুই ভাই বগুড়ায় থেকে গেলেও পরিবার নিয়ে ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ চলে যান রাজধানীতে। ১৫ বছর ধরে রাজধানী থেকেই পারিবারিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৫ বছর আগের সাধারণ হোমিও ব্যবসায়ী এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সামান্য হোমিও চিকিৎসক থেকে রাতারাতি উত্থানে হতবাক স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল ফকির বলেন, আলাদিনের চেরাগ না পেলে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুধু হোমিও ব্যবসা করে অল্প সময়ের ব্যবধানে এত টাকার মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
পারুল হোমিও হলের মালিকদের একজন নুর মোহাম্মদ সম্পর্কে চমকে যাওয়ার মতো নানা তথ্য দিয়েছেন স্বজনরা। স্বজনরাই বলছেন, ঢাকায় আসার পর তার উত্থান ঘটেছে ‘বিদ্যুৎ গতিতে’। পুরান ঢাকার জয়কালী মন্দিরের পাশে তিনি খুলেছেন ইউনিসন হোমিও হল। সেখানে পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি ওষুধ। এছাড়া যাত্রাবাড়ীতে তার মালিকানাধীন একটি ভবনে তার বিশাল কার্যালয়। ‘নুর মোহাম্মদ ভবন’ নামে সেই বহুতল ভবন থেকেই সব ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি।
পারিবারিক সূত্র বলছে, স্ত্রী জহুরা পারভিন শম্পাকে নিয়ে তার পরিকল্পনা রয়েছে দুবাইয়ে স্থায়ী হওয়ার। সেখানেও তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন তিনি।
সূত্র আরও জানায়, মাসখানেক আগে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে নিজের নামে ৮ বিঘা জমি কেনেন নুর মোহাম্মদ। চীনা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে একটি ওয়েস্টেজ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের ব্যয় শত কোটি টাকার কাছাকাছি হবে এমনটিই জানানো হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ৪০ হাজার স্কয়ার ফিট জমিতে বিশাল একটি হোমিও কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানান, পারুলের হোমিওর বিরুদ্ধে ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু সবসময়ই কোনো না কোনোভাবে তারা নিজেদের আড়াল করে।
নিজস্ব বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরা করা নুর মোহাম্মদ পরিবারসহ থাকেন পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। তার বড় মেয়ে মুমু মোহাম্মদকে বিয়ে দিয়েছেন দুবাইয়ের এক ধনকুবেরের ছেলের সঙ্গে। ছোট মেয়ে তানা মোহাম্মদ রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ের শিক্ষার্থী।
বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ বলেন, সম্প্রতি বিষাক্ত মদ পানে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন রঞ্জু মিয়া নামের একজনের ভাই মনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় পারুল হোমিও হল এবং পুনম হোমিও হলের মালিক নুর মোহাম্মদ (৫২), নূরনবী (৫৮) এবং নূরে আলম (৫৮) নামের তিন ভাইকে আসামি করা হয়েছে। আরও আসামি করা হয়েছে শহরের তিনমাথা রেলগেটের খান হোমিও হলের মালিক শাহীনুর রহমানকে। ২০১৮ সালেও একই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
জানা গেছে, এর আগে ১৯৯৮ সালে স্পিরিট পানে গাইবান্ধায় ৭১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় সরবরাহকারী হিসেবে পারুল হোমিওর নাম এসেছিল। থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ ঘুরে মামলাটি শেষ পর্যন্ত অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গেলে চার্জশিট হলেও পরে মামলার কার্যক্রম আর এগোয়নি। এছাড়া, ২০০০ সালে বগুড়ায় বিষাক্ত স্পিরিট পানে ২২ জন মারা যাওয়ার ঘটনার পেছনেও এই পারুল হোমিও হলের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ছিল।
বর্তমানে দুবাইয়ে আছেন নুর মোহাম্মদ। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে অনলাইনে কথা বলা হয়। নিজের উত্থান প্রসঙ্গে জাগো নিউজের কাছে তিনি দাবি করেন, মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে তিনি এই সম্পদ গড়েছেন।
অবৈধ স্পিরিটের ব্যবসার দায় ভাইদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে নিজেকে ‘সৎ’ ব্যবসায়ী বলে দাবি করেন তিনি। জানান, সরকারকে ট্যাক্স দিয়েই তার ব্যবসা পরিচালিত হয়।
নূর মোহাম্মদের দাবি, দেশে তার উত্থান দেখে শত্রুর পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ কারণে তিনি সপরিবারে দুবাইয়ে স্থায়ী হওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। সুত্রঃ জাগোনিউজ।