করোনার সংক্রমণ, মৃত্যু এখনো চলছেই। এরই মধ্যে নতুন দুশ্চিন্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে ‘ফাঙ্গাস’। এত দিন শুধু ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের’ কথা বলা হয়েছে। গত ২০ই মে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারি ঘোষণা করলো ভারত শুক্রবার থেকে আবির্ভাব ঘটেছে ‘হোয়াইট ফাঙ্গাসের’।
করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বে নতুন ‘মহামারি’ ফাঙ্গাস জনমনে আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা সংক্রমিতরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ায় তাদের মধ্যে আতঙ্কের মাত্রাও বেশি। এরই মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের ২৯টি রাজ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে মহামারি ঘোষণার সুপারিশ করেছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশে ফাঙ্গাসে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত না হলেও সীমান্তের ওপারে কলকাতায় গতকাল পাঁচজনের শরীরে নতুন এই রোগটি ধরা পড়েছে। এছাড়া মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশসহ বেশ কটি রাজ্যে ফাঙ্গাসের বিস্তার ঘটেছে। এরপরই দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারণসীতে চিকিৎসকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনায় বলেছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসও মারাত্মক আকার নিচ্ছে। আমাদের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে এই ছত্রাক। আমাদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লাভ আগারওয়াল দেশটির ২৯ রাজ্যের সরকারকে চিঠি লিখে নিজ নিজ রাজ্যে কালো ছত্রাকের সংক্রমণকে মহামারি ঘোষণা করার আহ্বান জানান।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে ফাঙ্গাসের আক্রমণ এখনো শুরু হয়নি। তবে অনেকেই বলেছেন, করোনার ভারতীয় ধরন যদি বাংলাদেশে চলে আসতে পারে এবং এর জন্য বাংলাদেশ সরকার বিধিনিষেধের নামে লকডাউনও জারি করেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ভারতে ফাঙ্গাস রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে এবং সবাইকে চমকে দিয়ে কলকাতায় রোগটি এসে পড়েছে ও পাঁচজনের শরীরে ছোবল দিয়েছে। করোনার ভারতীয় ধরন যদি বাংলাদেশে আসতে পারে তাহলে ফাঙ্গাসও অনায়াসে চলে আসতে পারে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।
পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় বর্তমানে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এর সঙ্গে ফাঙ্গাসও যোগ হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। কাজেই সরকারের উচিত, সীমান্ত এলাকায় গভীরভাবে নজর দেয়া।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ফাঙ্গাসে আমাদের দেশে এখনো কেউ আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। তবে অজ্ঞাত রোগে দুএকজন মারা গেছেন। আমার মনে হয় যারা মারা গেছেন তাদের ফাঙ্গাসই কেড়ে নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভারতে রোগটির প্রকোপ বেশি থাকায় আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রায় সব বিষয়ে মিল রয়েছে। এর ফলে যে কোনো সময় ফাঙ্গাসের প্রকোপ শুরু হতে পারে আমাদের দেশে। তিনি বলেন, ফাঙ্গাস থেকে রক্ষা পেতে হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি করোনার রোগীদের স্টেরয়েডও কম ব্যবহার করতে হবে।
এদিকে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের পর এবার নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে হোয়াইট ফাঙ্গাস বা সাদা ছত্রাক। ভারতীয় চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে দেশটির গণমাধ্যম বলছে, হোয়াইট ফাঙ্গাস তার আগে চিহ্নিত হওয়া বø্যাক ফাঙ্গাসের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক ও ভয়াবহ।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে ইতোমধ্যেই ভারতের জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন নতুন করে হোয়াইট ফাঙ্গাসের কথা আসছে। পর্যাপ্ত গবেষণা হলে পার্থক্যটা বোঝা যাবে। তবে যে কোনো ফাঙ্গাস ইনফেকশন হয় অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে।
করোনা রোগীদের বিশেষ করে আইসিইউতে থাকা রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে স্টেরয়েড দিতে হয়। করোনা থেকে সেরে ওঠার পর অনেকের দেখা যাচ্ছে ফাঙ্গাল ইনফেকশন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সেটারই এখন নানা ধরন নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন স্টেরয়েডের ব্যবহার থেকে এই সংক্রমণ শুরু হতে পারে। কোভিড-১৯ এ গুরুতরভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসায় তাদের জীবন বাঁচাতে এখন স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যেসব ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি থামানোর জন্যও ডাক্তাররা কোভিডের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শরীরে থাকা ফাঙ্গাল ইনফেকশন চাড়া দিয়ে ওঠে বলে জানান তিনি।
এখন ভারতীয় চিকিৎসকরা বলছেন, এটার বিপজ্জনক রূপ হলো হোয়াইট ফাঙ্গাস বা সাদা ছত্রাক। এই রোগের প্রভাবে ফুসফুসজনিত সমস্যা তৈরি হতে পারে। পেট, যকৃত, মস্তিষ্ক, নখ, ত্বক এবং গোপনাঙ্গেও ক্ষতি করতে পারে হোয়াইট ফাঙ্গাস। তবে হোয়াইট ফাঙ্গাস সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত যে কজন রোগী পাওয়া গেছে, তাদের লক্ষণ দেখে চিকিৎসকরা ধারণা করছেন হোয়াইট ফাঙ্গাস আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে দেশটির বিহার রাজ্যে অন্তত চারজন হোয়াইট ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হয়েছেন। তবে তারা করোনা আক্রান্ত হননি। কিন্তু করোনার লক্ষণ থাকলেও পরীক্ষায় তা ধরা পড়েনি। হোয়াইট ফাঙ্গাস আসলে কী, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সঙ্গে পার্থক্য কতখানি। ভারতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কোভিড থেকে আরোগ্যের পথে বা সুস্থ হয়ে ওঠাদের শরীরে বিরল যে সংক্রমণ- তার নাম ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ বা বৈজ্ঞানিক নাম মিউকোরমাইকোসিস। মিউকোরমাইকোসিস খুবই বিরল একটা সংক্রমণ। মিউকোর নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে এই সংক্রমণ হয়। সাধারণত এই ছত্রাক পাওয়া যায় মাটি, গাছপালা, সার এবং পচন ধরা ফল ও শাকসবজিতে। এই ছত্রাক সাইনাস, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা এইচআইভি/এইডস যাদের আছে, কিংবা করোনা বা অন্যকোনো রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম এই মিউকোর থেকে তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসায় ‘স্টেরয়েড’ ব্যবহারের সঙ্গে রোগীদের কালো ছত্রাকে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে যাদের ডায়বেটিস আছে তাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁঁকি অনেক বেশি।
চিকিৎসকরা বলেন, সাধারণত কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার ১২ থেকে ১৫ দিন পর শরীরে কালো ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লাভ আগারওয়াল ভারতের ২৯ রাজ্যের সরকারকে চিঠি লিখে নিজ নিজ রাজ্যে কালো ছত্রাকের সংক্রমণকে মহামারি ঘোষণা করার আহŸান জানান। মহামারি ঘোষণা করলে মন্ত্রণালয় থেকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে রাজ্যগুলোতে কী ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতজুড়ে ঠিক কত মানুষ কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা গেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি।
তবে গত সপ্তাহে মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপি জানান, তার রাজ্যে প্রায় এক হাজার ৫০০ মানুষ কালো ছত্রাকে সংক্রমিত হয়েছেন। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, গত দুই মাসে তাদের হাসপাতালে কালো ছত্রাকে আক্রান্ত ২৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। অথচ, গত বছরজুড়ে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়জন।
কিৎসকরা আরও জানান, কালো ছত্রাক রোগীর মস্তিষ্কে পৌঁছে গেলে মৃত্যু বলতে গেলে অনিবার্য। তাই রোগীর প্রাণ রক্ষায় ছত্রাকের মস্তিষ্কে পৌঁছানো আটকাতে তারা বাধ্য হয়ে আক্রান্তদের চোখ বা চোয়ালের হাড় অপরাসণ করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।