ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের আটটি মার্কেটের ১ হাজার ২৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯০৪টিই ভ্যাট দেয় না। ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। শতকরা হিসেবে ভ্যাট না দেয়া এই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৮ শতাংশ।
ভ্যাট গোয়েন্দার তিনটি দল জরিপ করে এ তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের (মূল্য সংযোজন কর) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।
তিনি জানান, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের উপ-পরিচালক তানভীর আহমেদ নারায়ণগঞ্জ, সহকারী পরিচালক মুনাওয়ার মুরসালীন ঢাকায় এবং সহকারী পরিচালক মালেকীন নাসির আকন্দ সাভারের জরিপ কাজে নেতৃত্ব দেন। তিনটি দলে ৪২ জন গোয়েন্দা কর্মকর্তা অংশ নেন।
এই আটটি মার্কেটের মধ্যে রয়েছে- নারায়ণগঞ্জের মার্ক টাওয়ার, সমবায় নিউমার্কেট, সায়েম প্লাজা, আল হাকিম (পপুলার) সেন্টার, সাভারের সিটি সেন্টার, ঢাকার উত্তরার ট্রপিক্যাল আলাউদ্দীন টাওয়ার ও আরএকে শপিং কমপ্লেক্স এবং বাড্ডার সুভাস্তু নজর ভ্যালি।
এই জরিপে মোট দোকান পাওয়া যায় ১ হাজার ২৪টি। এদের মধ্যে মোট ভ্যাট নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১২০টি। আর ভ্যাট দেয় না ৯০৪টি।
জরিপ অনুসারে ভ্যাট নিবন্ধিত ১২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাসে ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় মাত্র ৪৫টি। বাকি ৭৫টি ৫০০০ টাকার নিচে ভ্যাট প্রদান করে। অথচ জরিপের ফল অনুসারে এদের অধিকাংশের দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খরচ এবং মুনাফা অনুসারে এই পরিমাণ ভ্যাট সঙ্গতিপূর্ণ নয় মর্মে প্রমাণ মিলেছে।
মইনুল খান বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এদের প্রায় সবাই ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করেন। কিন্তু তারা যথাযথভাবে সরকারের কোষাগারে ভ্যাট পরিশোধ করেন না।
মাঠ পর্যায়ের এই জরিপে আরও দেখা যায়, কোনো কোনো মার্কেট গড়ে উঠেছে ১০ বছরেরও বেশি সময় আগে। মার্কেটের অনেক ব্যবসাও একই সময়ের। নতুন ভ্যাট আইনও বাস্তবায়ন হয়েছে দুই বছর হয়েছে।
কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও জরিপে প্রাপ্ত ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় আসেনি। তবে সুভাস্তু নজর ভ্যালিতে ঢাকা উত্তর কমিশনারেট থেকে গতকাল (বৃহস্পতিবার) ৫০০ দোকানকে বাধ্যতামূলক নিবন্ধন দিয়ে তা মার্কেটের নিচে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
জরিপ প্রতিবেদন বলছে, মার্কেট থেকে ভ্যাট সংগ্রহে রাজধানীর চেয়ে ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট প্রদানে অনীহা বেশি। এসব এলাকায় ভ্যাট আইন পরিপালন অপেক্ষাকৃত কম।
গত ২৫ মে নরসিংদীর দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটের জরিপে দেখা যায়, মার্কেট দুটির ২৩৭ প্রতিষ্ঠানের কেউই ভ্যাট দেয় না। এই মার্কেটগুলো হলো নরসিংদীর স্টেশন রোডের ইনডেক্স প্লাজা ও জামান শপিং কমপ্লেক্স।
ভ্যাট গোয়েন্দার নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকার ২৭ মের জরিপেও একই চিত্র ফুটে উঠেছে। এই দুই এলাকার ছয়টি মার্কেটের ৩৭২টি দোকানের মধ্যে মাত্র ১৮টি ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণ করেছে। বাকি ৩৫৪টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতাভুক্ত নয়। যারা নিবন্ধিত তাদের অধিকাংশ আবার যথাযথভাবে ভ্যাট প্রদান করে না।
এই আটটি মার্কেটে ভ্যাট গোয়েন্দার জরিপের প্রাথমিক ফলাফল নিম্নরূপঃ
১. মার্ক টাওয়ারে মোট দোকান ৩০টি। নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা একটি এবং অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ২৯টি। আর ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় একটি।
২. সায়েম প্লাজার মোট দোকান ৫০টি। নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা পাঁচটি এবং অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৪৫টি। আর ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় একটি এবং ৫০০০ টাকার নিচে ভ্যাট দেয় চারটি।
৩. সমবায় নিউমার্কেটে মোট দোকান ৮০টি। নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা একটি এবং অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৭৯টি। একটিও ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় না।
৪. আল হাকিম সেন্টারে (পপুলার) মোট দোকান ১৪টি। নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা একটি এবং অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১৩টি। ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় একটি।
৫. সিটি সেন্টারে মোট দোকান ১৯৮টি। নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১০টি এবং অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১৮৮টি। ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় আটটি এবং ৫০০০ টাকার নিচে ভ্যাট দেয় দুটি।
৬. ট্রপিক্যাল আলাউদ্দিন টাওয়ারে মোট দোকান ৮৩টি। নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৫০টি এবং অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৩৩টি। ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় আটটি এবং ৫০০০ টাকার নিচে ভ্যাট দেয় ৪২টি।
৭. আরএকে শপিং কমপ্লেক্সের মোট দোকান ৩৩টি। নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ২৬টি, অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা সাতটি। ৫০০০ টাকার নিচে ভ্যাট দেয় ২৬টি।
৮. সুভাস্তু নজর ভ্যালিতে মোট দোকান ৫২৬টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ২৬টি। ৫০০০ টাকার ওপরে ভ্যাট দেয় ২৬টি জুয়েলারি দোকান। অবশিষ্ট ৫০০টি দোকান ভ্যাট প্রদান করে না। ঢাকা উত্তর কমিশনারেট থেকে গতকালই এই ৫০০ প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক ভ্যাট নিবন্ধন প্রদান করে তা মার্কেট প্রাঙ্গন ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
মইনুল খান বলেন, ভ্যাট আইন অনুসারে যেকোনো ভ্যাটযোগ্য ব্যবসা শুরু করার পূর্বেই নিবন্ধন গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। মার্কেটগুলোতে খুচরা পর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট সংগ্রহ করে প্রতি মাসের ভ্যাট পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে স্থানীয় ভ্যাট সার্কেলে রিটার্ন জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। প্রতিটি বিক্রিতে ক্রেতাকে নির্দিষ্ট ফরমে মূসক-৬.৩ এ চালান দিতে হবে।
তিনি জানান, এনবিআরের নির্দেশে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতর এই বিশেষ জরিপ করছে। এই লক্ষ্যে চারটি জরিপ দলও গঠন করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এই চারটি দল মাঠে নেমে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের মার্কেটগুলোতে এই জরিপ করছে। এই জরিপে বিভিন্ন মার্কেট সমিতি ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা নিচ্ছে গোয়েন্দা দল।
ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর জরিপের এই ফলাফল এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দেবে। এর ওপর ভিত্তি করে এনবিআর কর্মকৌশল নির্ধারণ করবে। ভ্যাটযোগ্য ব্যবসাকে করের আওতাভুক্ত করা এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এই জরিপ।