দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালোরে একজন বাংলাদেশি নারীর গণধর্ষণের ঘটনায় ওই শহরের পুলিশ এ পর্যন্ত মোট দশজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে।গতকাল বুধবারেও শাহবাজ নামে একজন অন্যতম প্রধান অভিযুক্তকে বন্দুকযুদ্ধের পর আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ জানাচ্ছে। ইতোমধ্যে পাশের রাজ্য কেরালা থেকে এই ঘটনার ভিক্টিম ওই নারীকেও শহরে নিয়ে আসা হয়েছে।
এই ঘটনায় অভিযুক্তরা ও ভিক্টিম, সকলকেই যেহেতু ”অবৈধ বাংলাদেশি” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তাই এই ঘটনাটি নিয়ে ব্যাঙ্গালোরেও তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অ্যাক্টিভিস্ট ও মানবাধিকার আইনজীবীরা ভিক্টিমের আইনি অধিকারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আবার অনেকে মনে করছেন ব্যাঙ্গালোরকে ”অনুপ্রবেশ-মুক্ত করার” এটা একটা সুযোগ।
ব্যাঙ্গালোরের পুলিশ কমিশনার কমল পন্থ-কে টুইট করে নাভিনের মত অনেকেই বলছেন, ব্যাঙ্গালোর থেকে সব অবৈধ বাংলাদেশিকে এখনই তাড়ানো দরকার।
পারভিন সুতারের মত কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন পুলিশের নাকের ডগায় এরা এতদিন ধরে শহরে ছিল কীভাবে?
ব্যাঙ্গালোর পুলিশ ও বাহিনীর কর্মকর্তারাও নিয়মিত সাংবাদিক বৈঠক করে ও টুইট করে এই তদন্তের গতিপ্রকৃতি জানাচ্ছেন।
বস্তুত ব্যাঙ্গালোর শহরে বাংলাদেশিদের কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যু নিয়ে চর্চা নতুন কিছু নয়।
কিন্তু এক বাংলাদেশি তরুণীর ধর্ষণের মর্মান্তিক ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সপ্তাহখানেক আগে পুলিশ যে অভিযান শুরু করেছে, তা গোটা বিষয়টিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে অন্তত তিনজন আলাদা আলাদা ঘটনায় পুলিশি অভিযানের সময় পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
কর্নাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইও বলেছেন, প্রথমে তারা ভিডিওটির ”লোকেশন” নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না – কিন্তু এখন খুব দ্রুত গতিতে ”কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই” তদন্ত এগিয়ে চলছে।
ব্যাঙ্গালোরের একটি এনজিও-র কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট আর কলিমুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, সেখানে অবৈধ বাংলাদেশিরা কিন্তু এতকাল পুলিশকে মাসোহারা দিয়েই থেকেছেন।
তিনি জানাচ্ছেন, “আসলে এই শহরে বাংলাদেশিদের মধ্যেও দুটো শ্রেণি আছে। একদল নারী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত, অভিজাত এলাকায় বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে তারা দেহব্যবসা চালায়।”
“বাংলাদেশিদের এরকম প্রায় গোটা তিরিশেক গ্যাং আছে, তারা আয়েশি জীবন কাটায়। শহরের বহু ছাত্র, চাকরিজীবী তাদের গ্রাহক।”
“আর এক দল বস্তিবাসী, পৌরসভার ঠিকাদারের হয়ে তারা ময়লা কুড়িয়ে কোনওক্রমে বাঁচে – কিন্তু এদের ছাড়া ব্যাঙ্গালোরের এক দিনও চলবে না।”
“পুলিশ সবই জানে, দুধরনের লোকই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখে চলে – সাপ্তাহিক হফতা বা রোলকলের পয়সাও নিয়মিত পুলিশের কাছে পৌঁছে যায়।”
সুপরিচিত মানবাধিকার আইনজীবী মৈত্রেয়ী কৃষ্ণান আবার বিবিসিকে বলছিলেন, এই ঘটনায় ব্যাঙ্গালোর পুলিশ কিন্তু প্রথম থেকেই ”জেনোফোবিক” বা ভিনদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে।
মিস কৃষ্ণানের কথায়, “সবার আগে এটা একটা ধর্ষণের ঘটনা। সেটায় গুরুত্ব না-দিয়ে পুলিশ প্রথম থেকেই যেভাবে বলতে শুরু করেছে এটা অবৈধ বাংলাদেশিদের কাজ, সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক ও জেনোফোবিক।”
“ভিক্টিমের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, তাকে আশ্রয় দেওয়া সেটা আগে জরুরি ছিল – এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে তিনি কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাওয়ারও অধিকারী।”
“তিনি ভারতীয় না বাংলাদেশি সেটা এখানে বিচার্য নয় – তার নাগরিকত্ব কোথাকার তাতেও কিছু যায় আসে না।”
বছর দেড়েক আগে হাওড়া রেল স্টেশনে রেলকর্মীদের হাতে একজন বাংলাদেশি নারীর গণধর্ষণের ঘটনায় আইনজীবী চন্দ্রিমা দাস তার হয়ে যে মামলা করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট তাতে ভিক্টিমকে দশ লক্ষ রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
মৈত্রেয়ী কৃষ্ণান এখানে সেই মামলারও দৃষ্টান্ত টানছেন – এবং বলছেন ভারতে তদন্ত শেষ হওয়া বা সাজাভোগের পরই অভিযুক্তদের বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে।
ব্যাঙ্গালোরে অরবিন্দ লিম্বাভালি বা তেজস্বী সুরিয়া-র মতো বিজেপি নেতারা অতীতে বহুবার অবৈধ বাংলাদেশি তাড়ানোর ডাক দিয়েছেন।
অরবিন্দ লিম্বাভালি এখন কর্নাটক সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী, এর আগে তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একাধিকবার অবৈধ বাংলাদেশিদের বস্তি উচ্ছেদে বা ঘরবাড়ি ভাঙায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
দক্ষিণ ব্যাঙ্গালোরের এমপি তেজস্বী সুরিয়া পার্লামেন্টে নিজের বক্তৃতায় দাবি করেছেন, অবৈধ বাংলাদেশিরা ”জঙ্গী কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে” ব্যাঙ্গালোরের নিরাপত্তার জন্য বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছেন।
কিন্তু সস্তা রাজনীতি ছাড়া তাতে বিশেষ কিছুই হয়নি, মনে করেন ব্যাঙ্গালোরের বহু বছরের বাসিন্দা ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞ সুরঞ্জন সেন।
মি. সেন বিবিসিকে বলছিলেন, “অবৈধ বাংলাদেশিরা ব্যাঙ্গালোরে তেমন কোনও বড় রাজনৈতিক ইস্যু নয়। তবে বিজেপি নেতারা এটা ক্রমাগত বলে যান, ফলে শহরে কোনও চুরি-ছিনতাই হলে বাংলাদেশিরা শহরে ক্রাইম বাড়াচ্ছে এরকম খবর চলে আসে।”
“আর তারা শহরে থাকলেও যেহেতু মোটামুটি একই বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন, তাই বাইরের লোকজন অত বুঝতেও পারেন না এরা বাংলাদেশের মুসলিম না কি পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা মুসলিম।”
“এক-দুবছর আগে শহরে একটা বস্তি উচ্ছেদের পর জানা গেল ওটা পুরোটাই নাকি ছিল বাংলাদেশিদের একটা ‘চাউল’ (বস্তি), ওখানেই তারা থাকতেন।”
“তারপর দেখা গেল জনমতও আবার বিভক্ত হয়ে গেল … একদল বলতে লাগলেন এত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শহরে এলেন কী করে প্রশাসন আগে তার জবাব দিক।”
“আর এক দল বললেন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক।”
“কিন্তু তারপর যথারীতি আবার সব থিতিয়েও গেল।”
”ফলে কিছুদিন পর এরকম এক একটা ঘটনা ঘটে, তারপরেই ব্যাঙ্গালোর সবাই আবার নড়েচেড়ে বসে,” বলছিলেন সুরঞ্জন সেন।
গত এক সপ্তাহের ঘটনাক্রমে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ‘টিকটক রিদয়’ বা ‘রাফি’ নামে পরিচিত দুষ্কৃতীদের হাতে পাচার হওয়া তরুণীর গণধর্ষণ আরও একবার ব্যাঙ্গালোরের সেই পুরনো বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে। সূত্রঃ বিবিসি।