রোববার ১২ই সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর হওয়ার জন্য সংশ্নিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে সরকারের এ বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কারণে যেন কভিড-১৯-এর সংক্রমণ বেড়ে না যায়, সে জন্যই এ কড়াকড়ি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে তিনজনের স্থলে প্রতি বেঞ্চে বসবে দু’জন করে শিক্ষার্থী বসবে। গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারের এ বার্তা সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রধানদের জানিয়ে দেওয়া হয়। তাদের বলে দেওয়া হয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন বা গাফিলতি করা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালাতেও বলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা সংশ্নিষ্ট দুই মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রোববার খুলে দেওয়ার পর নজরদারি জোরদার করা হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রতিদিনের হালনাগাদ তথ্য প্রতিদিনই সরকারকে পাঠাতে হবে। সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড ও মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবেন। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে না জানিয়ে গোপনে হাজির হবেন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, রাজধানীর নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা বেশি। প্রতিষ্ঠানে ঢোকা ও ছুটির সময় বের হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বড় ধরনের জটলা তৈরি হয়ে স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের করণীয় এরই মধ্যে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের খামখেয়ালিপনা সহ্য করা হবে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক বেলাল হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ছাউনিতে অভিভাবকদের সামাজিক দূরত্ব মেনে অপেক্ষা করতে হবে। অকারণ আড্ডা দেওয়া, ভিড় করা যাবে না। মাস্ক ছাড়া কোনো শিক্ষক, কর্মচারী, অভিভাবক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পারবেন না। প্রবেশের মুহূর্তে হাত ধুয়ে স্যানিটাইজ করে সবাইকে প্রবেশ করতে হবে।
৯ দফা নির্দেশনা :খোলার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ৯ দফা নির্দেশনা মানতে হবে। গতকাল এ বিষয়ে এক পরিপত্র জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই ৯ দফা হলো- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথে সব শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত পরিমাপ ও পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পরিবেশে শ্রেণি কার্যক্রমে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা করা; শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার ক্ষেত্রে পারস্পরিক তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায়; প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করবে এবং বাসা থেকে যাওয়া-আসা করবে, সে বিষয়ে শিক্ষণীয় ও উদ্বুদ্ধকরণ ব্রিফিং করা; আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঠিকভাবে মাস্ক (সম্ভব হলে কাপড়ের মাস্ক) পরিধান করার বিষয়টি নিশ্চিত করা; শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উপস্থিতির সংখ্যা নিরূপণ করা ও সব শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব ওয়াশরুম নিয়মিত পরিস্কার রাখা এবং পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা; কভিড-১৯ অতিমারিজনিত সরকারের স্বাস্থ্যবিধি যথাসময়ে প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষকদের সমন্বয়ে পর্যবেক্ষণ ও নিশ্চিতকরণ কমিটি গঠন করা।
শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেবেন শিক্ষকরা :দীর্ঘ বিরতির পর রোববার প্রতিষ্ঠানে পা রাখায় স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেবেন শিক্ষকরা। নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের বরণ করে এদিন পাঠদান শুরু করবেন ভিকারুননিসা নূনের শিক্ষকরা। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক জানান, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর আবারও ক্লাসে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে তারা কিছু পরিকল্পনার কথা ভাবছেন। ক্লাসের প্রথম দিন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বরণ করে নেবেন তারা। বেইলি রোড, আজিমপুর, ধানমন্ডি ও বসুন্ধরায় ভিকারুননিসার চারটি শাখার প্রবেশপথের সব ফটক বেলুন ও জরি কাগজ দিয়ে সাজানো হবে। তিন ফুট দূরত্ব রেখে শিক্ষকরা গেটের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবেন। ছাত্রীরা যখন প্রবেশ করবে, শিক্ষকরা করতালি ও ড্রাম বাজিয়ে সংবর্ধনা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করানো হবে। এ আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্রীরা এক ধরনের আনন্দ উপভোগ করবে। স্কুলের প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়ে যাবে।
তবে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো শাখার দিবা ও মর্নিং শাখার প্রধানরা গেটে নয়, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার মুকুল বলেন, শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা বরণ করতে চাই। ছাত্রীরা গেটের ভেতরে প্রবেশ করার সময় প্রত্যেকের হাতে একটি করে ফুল দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও এতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বলে সেই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে।
প্রতিদিন নজরদারি প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ :রোববার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর কভিড-১৯ সংক্রান্ত উদ্ভূত যে কোনো সমস্যা নিরসনে প্রতিদিন নজরদারি প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ জারি করেছে মাউশি। গতকাল মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত এ নির্দেশনায় জানানো হয়, মাউশির আওতাধীন সব উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে তার আওতাধীন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিদিন নজরদারি করে বিকেল ৪টার মধ্যে নির্ধারিত ছক অনুযায়ী কেবল সমস্যা চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানের তথ্য মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের ই-মেইলে পাঠাতে হবে।
নির্ধারিত ছকে তারিখ উল্লেখ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম এডুকেশন ইনস্টিটিউশন আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ইআইআইএন), প্রতিষ্ঠান প্রধানের নাম, মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল আইডি এবং উপজেলা/থানার নাম ও জেলার নাম, সমস্যার ধরন ও সমস্যা সমাধানের তথ্য পাঠাতে হবে।
একসঙ্গে খুলছে না সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুল :রোববার উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও রাজধানী ঢাকার সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ওইদিন একই সঙ্গে খুলছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বিদ্যালয়গুলো তাদের নিজ নিজ সুবিধামতো সময়ে এ মাসের মধ্যেই খুলে দেওয়া হবে। স্কলাসটিকা উত্তরার স্টুডেন্ট রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার ফাতেমা সোহেলী সমকালকে জানান, রোববার তারা প্রতিষ্ঠান খুলছেন না। খোলার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শেষ হতে তাদের আরও কয়েকদিন লাগবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি যথারূপে প্রতিপালনের বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খোলার চূড়ান্ত তারিখ এখনও নির্ধারণ হয়নি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তারা এ বিষয়ে অভিভাবকদের জানাবেন।
ধানমন্ডির ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি সিটি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানে ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর এ ছুটি শেষ হবে। এ সময়কালে অনলাইন পাঠদানও বন্ধ থাকবে। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে যথারীতি বিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে।
গ্রিন রোডের ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুল কর্তৃপক্ষ রোববারই বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে রুটিন শিক্ষার্থীদের এসএমএস করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক কাজী তাইফ সাদাত সমকালকে বলেন, একসঙ্গে না খুললেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বড় অংশই রোববার থেকে খুলে দেওয়া হবে। দু-চারটি প্রতিষ্ঠান হয়তো পরে খুলবে।