দেশজুড়ে যে সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী র্যাব দালাল বিরোধী অভিযান শুরু করেছে, অভিযানের প্রথম দিনেই সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ৫০০ দালাল গ্রেফতার ও জেল জরিমানাও হয়েছে। এমন সময় বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের এক চিকিৎসক এর বিরুদ্ধে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠাতে রোগী ও রোগীর অভিবাবকদের মিথ্যা বলা, এমনকি সরকারি হাসপাতালে অপারেশন করালে রোগী মারা যেতে পারে, এমন কথা বলে প্ররোচিত করার অভিযোগ উঠেছে।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. একেএম মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে। ‘সরকারি এই হাসপাতালের (শেবাচিম) পরীক্ষা-নিরীক্ষা মানসম্মত নয়। সুচিকিৎসার জন্য বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা ও অপারেশন করাতে হবে।’ মূলতঃ প্রাইভেট হাসপাতাল রোগী নেয়ার জন্য তিনি এমন মিথ্যা কথা বলে রোগীর অভিবাবকদের প্ররোচিত, প্রভাবিত করার কাজে লিপ্ত হন।
এ ঘটনায় বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী এক অভিভাবক। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সচেতন বার্তার প্রতিবেদককে জানান, অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পরিচালক বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরে সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. নাজমুল হককে প্রধান করে একটি তদন্ত বোর্ড গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তবে তদন্ত প্রধান করোনা আক্রান্ত হওয়ায় প্রতিবেদন পেতে দেরি হচ্ছে। প্রতিবেদনে অভিযুক্ত চিকিৎসক দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
উল্লেখ্য যে, ঘটনাটি ঘটেছে চলতি বছরের ২২ আগস্ট। তবে শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) বিষয়টি জানাজানি হয়।
অভিযোগকারী ভুক্তভোগী অভিভাবক রাসেল হোসেন বলেন, ‘১৬ আগস্ট আমার ৯ বছরের অসুস্থ মেয়ে শুকরিয়াকে চিকিৎসার জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করাই। তাকে অপারেশনের জন্য শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. একেএম মিজানুর রহমান ভর্তির ১৫ দিন আগে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করা মেয়ের (শুকরিয়ার) শারীরিক পরীক্ষার প্রতিবেদন এবং ১৬ আগস্ট শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করা শারীরিক পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখে বলেন-এগুলো রিপোর্ট চলবে না।’
ডা মিজানুর রহমান হাসপাতালের সামনের “আবিদ ইসলামিয়া ডায়গনস্টিক ল্যাব” ও “ডা. নজরুল ইসলাম” এর আলট্রাসনো সেন্টার থেকে টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট আনতে বলেন। অন্যথায় সুচিকিৎসা মিলবে না বলেও জানান তিনি।
অভিযুক্ত ডা. একেএম মিজানুর রহমানের নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করানোর পর তিনি জানান শিশু শুকরিয়ার পেটের নাড়িতে প্যাঁচ লেগেছে। তার (রোগীকে) জরুরি অপারেশন করতে হবে। অন্যথায় সে বাঁচবে না।
শুকরিয়ার পিতা রাসেল ডা. মিজানুর রহমানের বরাত দিয়ে বলেন, শুকরিয়ার পেটের নাড়ির প্যাঁচের অপারেশন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হবে না। এখানে অপারেশন করার পর রোগী বাঁচবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। এজন্য হেমায়েত উদ্দিন ডায়াবেটিক হাসপাতালে অপারেশন করাতে বলেন। এতে সাকুল্যে খরচ হবে ৩০ হাজার। এছাড়া থাকা-খাওয়ার খরচ আলাদা। শেষে ডাক্তারের কথামতো বাধ্য হয়ে হেমায়েত উদ্দিন ডায়াবেটিক হাসপাতালে মেয়ের অপারেশন করান।
শুকরিয়ার পিতা আরও বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের এমন আচরণে আমি হতবাক। আমরা গরিব মানুষ। আর্থিক অনটনের কারণেই কম খরচে ভালো সেবা পাওয়ার আশায় সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে চিকিৎসক আমাকে আশ্বস্ত করার পরিবর্তে আমার সন্তান (রোগী) মারা যাওয়ার ভয় দেখানো ও বেসরকারি হাসপাতালের নাম উল্লেখ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো কতটা যৌক্তিক? আমার প্রশ্ন এই হাসপাতালে কি এমন রোগীর অপারেশন সম্ভব না?’
অভিযোগের বিষয়ে চিকিৎসক একেএম মিজানুর রহমান জানান, আবিদ ইসলামিয়া ডায়গনস্টিক ল্যাবের রিপোর্ট ভালো তাই সেখানে পরীক্ষা করাতে বলেছিলাম। আমি নিজেও সেখানে পরীক্ষা করাই। এমারজেন্সি রোগীর অপারেশন দরকার হলে অনেক সময় সিডিউল না থাকায় শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারেশন করা সম্ভব হয় না। তাই হেমায়েত উদ্দিন ডায়াবেটিক হাসপাতালে অপারেশন করার জন্য বলেছি। সেখানে আমি নিজেই অপারেশন করি। মেডিকেলে শিশু সার্জারির জন্য সপ্তাহে একদিন শনিবার অপারেশন করা হয়। আবার সকাল ৮টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত সিনিয়র চিকিৎসকরা থাকেন। এরপর যারা থাকেন তারা ইন্টার্ন চিকিৎসক। তখন তো অপারেশন বন্ধ থাকে। আবার বিকালে অজ্ঞান (অ্যানেসথেসিয়া) করার ডাক্তার থাকে মাত্র একজন। সেই একজনকেই গাইনি, অর্থোপেডিক, সার্জারি সব বিভাগ দেখতে হয়। রুটিন অপারেশনের বাইরে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারেশন করার সুযোগ থাকে না। এজন্য প্রাইভেটে অপারেশন করার জন্য বলেছি। এতে আমার আলাদা কোনো লাভ নেই।
অভিযুক্ত চিকিৎসকের বলা মতে, তিনি নিজেই হেমায়েত উদ্দিন ডায়াবেটিক হাসপাতালে অপারেশান করেন তাই সেই হাসপাতালেই অপারেশান করার জন্য বলেছেন। আবার তিনিই বলছেন, ‘এতে আমার আলাদা কোনো লাভ নেই।’ একদিকে সরকারি মাইনে নিচ্ছেন। আবার সরকারি হাসপাতালে অপারেশান করার সুযোগ থাকেনা বলে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে নিজেই অপারেশন করিয়ে সেখান থেকে পাচ্ছেন অপারেশন করার মজুরী।
এদিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগের বিষয়টি ১০ই সেপ্টেম্ব রজানাজানি হবার পরে সাধারণ জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বরিসাল নগরীতে জনৈক স্বপন নামের এক ব্যাক্তি যিনি ঢাকার মিরপুরে হারফি নামক একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে চাকরি করেন। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে গিয়ে স্বপন বলেন, চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্ত একজন সরকারি চাকুরিজীবি নৈতিকতার এই স্থলন তাকে হাসপাতালের গেটের আশেপাসে ঘুরে বেড়ানো রোগীধরা দালালদের কাতারেই দাঁড় করায়।