দেশের কয়েক জায়গায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমে আইনের ব্যত্যয় ঘটার অভিযোগ উঠেছে। অনেক বিচারপ্রার্থী এতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
সম্প্রতি দেশের কয়েক জায়গায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়ে বেশ কিছু নালিশি দরখাস্ত (আমলে গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের মতো) অনুসন্ধান না করে সরাসরি থানা পুলিশকে মামলা হিসেবে এফআইআর গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের একাধিক মামলার ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারা অনুসরণে বিচ্যুতি ঘটেছে।
ঘটনা ১: হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ এক ভুক্তভোগী ৮ জনের বিরুদ্ধে নালিশি দরখাস্ত দাখিল করেন (ট্রাইব্যুনাল মামলা নম্বর: ২১৪/২১)। পরে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে (অনুসন্ধানের রিপোর্ট ছাড়া) বিচারক ২ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এফআইআর গ্রহণের আদেশ দেন (থানার মামলা নম্বর ৩(৯)২১)। আদেশে বলা হয়, নালিশি দরখাস্তটি মামলা হিসেবে রেজিস্ট্রি করা হোক। দরখাস্তকারীর হলফনামা গ্রহণ করা হলো। নালিশি দরখাস্ত ও জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলায় আনা অভিযোগের প্রাথমিকের সত্যতা আমলযোগ্য।
এমতাবস্থায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ (৩) তৎসহ দণ্ডবিধি ৩৪২/৩৪৭/৩২৩/৩২৫/৩০৭/৩৮৫/৫০৬(২) ধারায় ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার জন্য থানা কর্র্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আদেশপ্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে মামলা রুজুসংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিচারক অভিযোগকারীর নালিশি দরখাস্তের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পদ্ধতি বাদ দিয়ে সরাসরি মামলা রেকর্ড করতে পুলিশকে আদেশ দেন। অভিযোগ উঠেছে, এ ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারাকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
ঘটনা-২: ঢাকার ৮ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে ৮ জনের বিরুদ্ধে একটি নালিশি দরখাস্ত দাখিল করেন এক নারী (ট্রাইব্যুনাল মামলা নম্বর: ১০৮/২০২১)। বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে বিচারক ৬ সেপ্টেম্বর নালিশি দরখাস্তটি (অনুসন্ধান রিপোর্ট ছাড়াই) সরাসরি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করতে রাজধানীর গুলশান থানাকে আদেশ দেন। ওই দিনই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নালিশি দরখাস্তসহ আদেশের কপি গুলশান থানায় পাঠানো হয় আদালত থেকে। চার পৃষ্ঠার ওই আদেশে বলা হয়েছে, নালিশি দরখাস্ত এফআইআর হিসেবে গণ্য করে আদেশপ্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ (১) (২)/৩০ তৎসহ দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারা অনুসারে তদন্তের জন্য মামলার নথি ডিআইজি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, হেডকোয়ার্টার্স ঢাকা বরাবর প্রেরণ করবেন। এ ক্ষেত্রেও বিচারক অভিযোগকারীর নালিশি দরখাস্তের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পদ্ধতি বাদ দিয়ে সরাসরি মামলা রেকর্ড করতে পুলিশকে আদেশ দেন। এ ক্ষেত্রেও ২৭ ধারাকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনা-৩: লালমনিরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে তিনজন আসামির বিরুদ্ধে নালিশি দরখাস্ত দাখিল করেন একজন নারী (ট্রাইব্যুনাল মামলা নম্বর: ২৩/২১)। পরে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে (অনুসন্ধান রিপোর্ট ব্যতিরেকে) বিচারক গত ১০ জুন জেলার পাটগ্রাম থানাকে নালিশি দরখাস্তটি সরাসরি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। আদেশে বলা হয়, আদেশের কপিপ্রাপ্তির সাত কার্যদিবসের মধ্যে মামলাটি রেকর্ডসংক্রান্ত তথ্য ওই ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করিতে নির্দেশ হইল। এই বিচারকও অভিযোগকারীর নালিশি দরখাস্তের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পদ্ধতি বাদ দিয়ে সরাসরি মামলা রেকর্ড করতে পুলিশকে আদেশ দেন। এ ক্ষেত্রেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারাকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে কয়েকজন বিচারক আইনের এ ধারা উপেক্ষা করে নালিশি দরখাস্ত সরাসরি মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে থানাকে আদেশ দেন। এর মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারার বিচ্যুতি ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আইনের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, ১[(১) সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্নে নহেন এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা এতদুদ্দেশ্যে সরকারের নিকট হইতে সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির লিখিত রিপোর্ট ব্যতিরেকে কোন ট্রাইব্যুনাল কোন অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করিবেন না। (১ক) কোন অভিযোগকারী উপ-ধারা (১)-এর অধীন কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোন অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করিয়া ব্যর্থ হইয়াছেন মর্মে হলফনামাসহকারে ট্রাইব্যুনালের নিকট অভিযোগ দাখিল করিলে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগকারীকে পরীক্ষা করিয়া, (ক) সন্তুষ্ট হইলে অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য কোন ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিকে নির্দেশ প্রদান করিবেন এবং অনুসন্ধানের জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি অভিযোগটি অনুসন্ধান করিয়া সাত কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের নিকট রিপোর্ট প্রদান করিবেন; (খ) সন্তুষ্ট না হইলে অভিযোগটি সরাসরি নাকচ করিবেন। (১খ) উপ-ধারা (১ক)-এর অধীন রিপোর্টপ্রাপ্তির পর কোন ট্রাইব্যুনাল যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, (ক) অভিযোগকারী উপ-ধারা (১)-এর অধীন কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোন অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করিয়া ব্যর্থ হইয়াছেন এবং অভিযোগের সমর্থনে প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে সেই ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল উক্ত রিপোর্ট ও অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধটি বিচারার্থে গ্রহণ করিবেন; (খ) অভিযোগকারী উপ-ধারা (১)-এর অধীন কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কোন অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করিয়া ব্যর্থ হইয়াছেন মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায় নাই কিংবা অভিযোগের সমর্থনে কোন প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় নাই, সেই ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগটি নাকচ করিবেন। (১গ) উপ-ধারা (১) এবং (১ক)-এর অধীন প্রাপ্ত রিপোর্টে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ বা তৎসম্পর্কে কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনাল, যথাযথ এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে করিলে, কারণ উল্লেখপূর্বক উক্ত ব্যক্তির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ করিতে পারিবেন।]
এ বিষয়ে সাবেক বিচারক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ফৌজদারি আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারার অধীনে সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারীরা অভিযোগ আনলে ট্রাইব্যুনালগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়েরকৃত অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেট, বিশেষ করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ দেন। এ ধরনের আদেশ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এ ধরনের আদেশের কথা আলোচিত আইনের ২৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে বেশ কিছু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে আমলে গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের মতো দাখিলকৃত অভিযোগগুলোকে (নালিশ) এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য থানাকে আদেশ দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারার বিপরীত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৭ ধারা, ২৫ ধারা এবং ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার ২০০৯-এর অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল একজন আমলে গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটের মতো কোনো অভিযোগকে এজাহার হিসেবে গণ্য করার আদেশ দিতে পারেন না, যেমন পারেন না দায়রা আদালত। কেননা ওই ট্রাইব্যুনালও দায়রা আদালতের মতো বিচারিক কার্যক্রমে সমতুল্য। সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন।