চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় গতকাল রোববার পর্যন্ত ৪৩ জন নিহত হয়েছে। এসব ঘটনায় দায়ের ৩৪টি মামলায় আসামি কয়েক হাজার। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুনের মামলার আসামি ধরা পড়ছে না। গতকাল পর্যন্ত ১৩৫ জন গ্রেপ্তার হলেও নরসিংদীতে ৯ খুনের ছয়টি মামলায় একজন আসামিও ধরা পড়েনি। কুমিল্লার মেঘনার বাওড়খোলা ইউনিয়নে সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনায় মামলাই হয়নি!
হতাহত ও হামলাকারী- উভয় পক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থক। অতীতে ভোটের সহিংসতায় খুনের বিচারের নজির বিরল। ভোটের রাজনীতি থাকায় এবারের হত্যাকাণ্ডগুলোরও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হবে- এ সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
পাবনায় নিজ দলের সমর্থককে হত্যা মামলার আসামিদের নিয়ে বিজয়ী মেম্বার প্রার্থী মিষ্টিমুখ করিয়েছেন সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল ওহাবকে। ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হলেও আসামিদের ধরতে পুলিশ তৎপর নয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইউপি নির্বাচনে নিহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই ছিলেন চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক, যাদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের মৃত্যুতে পরিবারগুলো মানবেতর অবস্থায় পড়েছে। যে প্রার্থীর পক্ষে সহিংসতায় জড়িয়ে প্রাণ দিয়েছেন, তারাও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন- এমন নজির কম। হতাহতের বেশিরভাগ পরিবার দরিদ্র হওয়ায় বিচারের আশাও ছেড়ে দিয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভোট আয়োজন করে দায় সেরেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার ভাষ্য, ইউপি ভোটে ‘সে রকম’ সহিংসতা হচ্ছে না। আবার কখনও তিনি বলেছেন, ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়।
সহিংসতা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সর্বশেষ গত ১৫ নভেম্বর ইসিকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও তার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতাকে ‘একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েই থাকে’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
আসামি পালিয়ে থাকায় ধরা পড়ছে না- পুলিশের এ বক্তব্য নাকচ করেছেন বাহিনীর সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক। তিনি সমকালকে বলেন, ‘মামলা হলে আসামি পালিয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু ধরতে না পারা দুঃখজনক। আসামি পলাতক হলে গোয়েন্দা নিয়োগ করে খুঁজে বের করতে হবে। এটাই পুলিশের কাজ। আসামি ধরতে না পারলে পুলিশেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, ‘খুনোখুনির বিষয়টি দেখা হচ্ছে- কারা মারছে, কী কারণে মারা হচ্ছে। স্থানীয় নির্বাচন, বিশেষ করে ওয়ার্ড পর্যায়ে মেম্বারদের বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। এ কারণে খুনোখুনি বেশি হয়। হতাহত ও হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে।’
২০১৬ সালে ছয় ধাপে চার হাজার ১০৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত ভোট। সমকালের হিসাবে ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ডেমক্রেসিওয়াচ নামে একটি সংস্থার হিসাবে গতবার শুধু ভোটের দিনগুলোয় প্রাণ গিয়েছিল ৬৩ জনের। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলটির বিদ্রোহীদের সমর্থকদের সংঘর্ষ ছিল প্রাণহানির প্রধান কারণ। এবারও একই কারণে রক্ত ঝরছে। গত নির্বাচনে হতাহতের ঘটনায় কারও সাজা পাওয়ার নজির খুঁজে পায়নি সমকাল।
এবার যাদের প্রাণ যাচ্ছে, তাদের হত্যারও বিচার হবে না বলেই আশঙ্কা করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি সমকালকে বলেন, আইন তার আপন গতিতে চলে না এ ক্ষেত্রে। যদি নিহত কারও পক্ষে ক্ষমতাবান কেউ থাকে, তাহলে আসামিদের কিছু ক্ষেত্রে ধরা হয়। তিনি বলেন, নির্বাচনের আয়োজক ইসি। তাদেরই দায়িত্ব ভোটে সহিংসতা বন্ধ করা; সহিংসতা হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে ইসির অসীম ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তাদের ইচ্ছা নেই। পুলিশ ও প্রশাসন যেমন পক্ষপাতদুষ্ট, ইসিও তাই।
গত এপ্রিলে ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপ অনুষ্ঠিত হয়। করোনার কারণে এরপর নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৬টি ইউপিতে নির্বাচন হয়। আগামী ২৮ নভেম্বর এক হাজার সাতটি ইউপিতে নির্বাচন হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ভোটে শনিবার রাতে যশোরে দু’জনসহ ৪৩ জন নিহত হয়েছেন।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের মো. শফি (৪৫) নিহত হয়েছেন দ্বিতীয় ধাপের ভোট চলাকালে। ভোটকেন্দ্রের পাশে চায়ের দোকানে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মারামারিতে তার প্রাণ যায়। নিহতের স্ত্রী সেলিনা আকতার থানায় আটজনের নামসহ ১০-১৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে মামলা করলেও একজনও গ্রেপ্তার হয়নি।
দ্বিতীয় ধাপের ভোট চলাকালে কুমিল্লা জেলার মেঘনার মানিকাচর ইউনিয়নের আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাকির হোসেন ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হারুন অর রশিদের সমর্থকদের সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালালে শাওন মিয়া (২৪) নিহত হন। তবে পুলিশের দাবি, তাদের গুলিতে মৃত্যু হয়নি। প্রিসাইডিং অফিসার মফিজুল ইসলাম অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে মামলা করেছেন।
একই দিন বাওড়খোলা ইউনিয়নের খীড়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট গ্রহণকালে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আঘাত পেয়ে নিহত হন সানাউল্লাহ ঢালী (৬০)। মামলা হয়নি জানিয়ে মেঘনা থানার ওসি মো. চমিউদ্দিন বলেছেন, কেউ অভিযোগ করেনি।
ঢাকা বিভাগে ১৬ জনের প্রাণ গেছে ইউপি নির্বাচনে। সর্বোচ্চ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। তাদের সবাই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। সাতটি মামলা হয়েছে। আলোকবালি ইউনিয়নে তিনজন খুনের ঘটনায় সাতজন গ্রেপ্তার হয়েছে। আসামি পলাতক থাকায় বাকি ছয় খুনে এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন সহকারী পুলিশ সুপার সত্যজিৎ কুমার ঘোষ।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার বানিবহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ মিয়া খুন হন ১১ নভেম্বর। তিনি আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তার হত্যা মামলায় পাঁচ আসামি গ্রেপ্তার হলেও বাকিরা অধরা।
ঢাকার ধামরাইয়ে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তিন কর্মী নিহত হন। নিহত তিনজনের একজন সিহান হোসেনের (২১) ভাই সজীব হোসেন বলেন, ‘২২ দিন পার হলেও একজন খুনিকেও ধরতে পারেনি পুলিশ। আমরা এখন কার কাছে বিচার চাইব? খুনিরা কি পার পেয়ে যাবে?’
নিহত রাতুলের মা কামরুন নাহার বলেন, আমার ছেলেকে নৌকায় ভোট দেওয়ার কারণেই হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে ধরলেও বাকিরা অধরা।
ধামরাই থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, তিন মামলার একটির এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের ধরতে চেষ্টা চলছে।
বরিশাল বিভাগের তিন জেলায় সাতজনের প্রাণ গেছে। পিরোজপুর পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল মাহবুব শুভকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জেলা আওয়ামী লীগ দাবি করেছে। তাদের অভিযোগ, জেলা আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন মাতুব্বরের পরিকল্পনায় শুভকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম আউয়ালের সভাপতিত্বে শুক্রবার অনুষ্ঠিত শোকসভা থেকে এ অভিযোগ করা হয়।
রংপুরে ভোটের সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিনজনের। পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের পঞ্চানন গ্রামের নিহত আবদুর রহিমের (৩৮) স্ত্রী শাহিনুর বেগম ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। শাহিনুর বেগম সমকালকে বলেন, রফিকুল মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
পীরগাছা থানার ওসি আজিজুল ইসলাম বলেন, একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রফিকুলসহ বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।
পাবনার সুজানগরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক সবুজ হোসেন (৩৪) হত্যা মামলায় ১৪ দিনেও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। আসামিরা সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী। পুলিশ খুঁজে না পেলেও আসামিরা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল ওহাবকে মিষ্টি খাওয়ানোর ছবি ফেসবুকে দিয়েছেন।
সুজানগর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল আলম বলেন, আসামি ধরতে কয়েকবার রেইড দিয়েছি।
দ্বিতীয় ধাপে মাগুরায় চারজন ও মেহেরপুরে দু’জন নিহত হয়েছেন। তাদের সবাই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। গত ১৫ অক্টোবর মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়নে নিহতদের তিনজন ছিলেন আপন ভাই ও একজন চাচাতো ভাই। এসব খুনের ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যে প্রার্থীদের পক্ষে সহিংসতায় জড়িয়ে প্রাণ গেছে, তারা কেউ হতাহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াননি। দলের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা মেলেনি। তবে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন। প্রয়োজনে সহযোগিতা করা হবে।
মাগুরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুরের ধলাগ্রামে ইউপি মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে দুই ভাই জাহারুল ইসলাম (৫৪) ও সাহাদুল ইসলাম (৫১) নিহত হন। পেশায় প্রান্তিক কৃষক এ দুই ভাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। মেহেরপুরের পুলিশ সুপার রাফিউল আলম বলেছেন, মামলার ৬৬ আসামির মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরও ধরতে তৎপরতা চলছে।