খাদ্য সরবরাহের নামে কারা অধিদফতরের আওতাধীন কারাগারগুলোতে সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন দরপত্র ক্রয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী, তাদের সহযোগী ও মূল্যায়ন কমিটির কিছু অসাধু কর্মকর্তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কারা বন্দীদের খাদ্য কেনার নামে সরকারি অর্থ লুটপাট করছে।
এই সিন্ডিকেটের কারণে প্রতি বছর ঘুরেফিরে একই ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরাই খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব পায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
শুধুমাত্র কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর চলতি অর্থ বছরের (২০২১-২২) ডাল সরবরাহে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়ায় সরকারের প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়টিসহ গত তিন বছরে (২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর) কারা অধিদফতরের দরপত্রে কয়েকজন দরদাতার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও একাধিক দরপত্রে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে কাজ বাগিয়ে নিয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
দুদকের পক্ষ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আর বিষয়টি আমলে নিয়ে কারা অধিদফতরকে দ্রুত তদন্ত করে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা) সৈয়দ বেলাল হোসেন গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারাগারের বিষয়ে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারেরও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এখানে অভিযোগের শেষ নেই। ফাইল না দেখে কিছু বলা যাবে না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিয়ন্ত্রণাধীন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে খাদ্য সরবরাহে নানা অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রচলিত নিয়মে দরপত্র আহ্বান করা হলে সর্বনিম্ন দরদাতাই কাজ পাওয়ার কথা। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এমন কিছু শর্ত দেয় যাতে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানই শুধু কাজ পায়। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে একটি সিন্ডিকেটকে খাদ্যপণ্য সরবরাহের কাজ দিচ্ছে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ চলতি বছরের অক্টোবর হতে আগামী বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মেয়াদে মসুর ডাল সরবরাহের দরপত্রে (ইজিপি টেন্ডার নং-৫৮৭৬৯৫) মোট ১০টি শিডিউল বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৯টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রতি কেজি মসুর ডালের সর্বনিম্ন দর ছিল ৫৯ টাকা এবং সর্বোচ্চ ছিল ৮৭ টাকা। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিয়ম ভঙ্গ করে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ডাল সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের ১ কোটি ৩১ লাখ ২৯ হাজার ২০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগকারীদের দাবি, কারা অধিদফতরের দরপত্রের শিডিউলে এমন শর্ত দেওয়া হয় যাতে তাদের পছন্দের একটি পরিবারের প্রতিষ্ঠানগুলোই কাজ পায় এবং শর্তগুলো তাদের পরিবারের প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পালন করা সম্ভব না হয়। কারা অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ ক্রয় দরপত্র টেন্ডার ওই সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি। এমনকি পছন্দের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে পুনঃদরপত্র আহ্বান করারও ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। কারা অধিদফতরের ক্রয় সংক্রান্ত দরপত্রে বারবার একই সিন্ডিকেটের প্রতিষ্ঠান কাজ পাওয়ার বিষয়টি গত ৩ নভেম্বর দুদকে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) ও কারা অধিদফতরের মহা কারাপরিদর্শকের দফতরেও আলাদা অভিযোগ দিয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক অভিযোগটি আমলে নিয়ে তা খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে। এরপর গত ১১ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট অভিযোগের কপিসহ ফাইলটি কারা অধিদফতরে পাঠায় সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এতে বলা হয়-কারা অধিদফতরের বিভিন্ন দরপত্র ক্রয় কার্যক্রম ও দরপত্র ক্রয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী, তাদের সহযোগী ও মূল্যায়ন কমিটি হতে একাধিক ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতার অপব্যবহার, অন্যায়, আইন লঙ্ঘন, বেআইনি, পক্ষপাতমূলক কর্মকান্ড সরকারের আর্থিক ক্ষতি ও অর্থ লোপাটের বিষয়ে অভিযোগ। গত তিন বছরে (২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর) কারা অধিদফতরের দরপত্রে কয়েকজন দরদাতার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও একাধিক দরপত্রে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগ। দুদকের এ সংক্রান্ত অভিযোগপত্রের ছায়ালিপি নির্দেশক্রমে এর সঙ্গে পাঠানো হলো। এ বিষয়ে তদন্তপূর্বক আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন কারা অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের ক্রয় কমিটির সভাপতি কারা উপ-মহাপরিদর্শক তৌহিদুল ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো ধরনের অনিয়ম করা হয়নি। ক্রয় ও দরপত্রের বিদ্যমান বিধি-বিধান মেনেই এসব দরপত্রের কাজ দেওয়া হয়েছে। কারাগারে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের বিষয়ে একটি সিন্ডিকেট অনৈতিকভাবে টেন্ডার কার্যক্রমে সুবিধা নিতে না পেরে এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করেছে নানা জায়গায়। তাদের কাগজপত্রের ত্রুটি ও নানা কারণেই দরপত্র মূল্যায়নে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। শুধু সর্বনিম্ন দরদাতা দরপত্রের শর্ত নয়। অনেকগুলো শর্ত পূরণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। এর সব ধরনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও আমাদের কাছে রয়েছে।’