fbpx
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
বাড়িজাতীয়সড়ক মন্ত্রণালয়ে মিলেমিশে গাড়ি অপব্যবহার

সড়ক মন্ত্রণালয়ে মিলেমিশে গাড়ি অপব্যবহার

সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগে সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ অপব্যবহার চলছে। জ্বালানি তেল ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতের টাকা নিয়েও হচ্ছে নয়ছয়। করোনা মহামারির কঠিন পরিস্থিতিতে যখন সরকারি অফিস বন্ধ কিংবা অর্ধেক জনবল দিয়ে কাজ হয়েছে, তখনো অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানো হয় এই খাতে। শুধু রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ করা হয় প্রায় ১৩ কোটি টাকা। গাড়ি নিয়ে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর এই অভিযোগ, তারা প্রত্যেকে প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এমন অনিয়ম-দুর্নীতিতে মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়াও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে।

এদিকে এই চিত্র শুধু সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগে নয়, প্রতিটি মন্ত্রণালয় বিভাগে কমবেশি একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণে গাড়ি কেনার বিশেষ সুবিধা ছাড়াও কর্মকর্তারা গাড়ির পরিচালন ব্যয় বাবদ তুলে নিচ্ছেন প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা। অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো অবস্থা। কিন্তু তা সত্ত্বেও একশ্রেণির আমলার সরকারি গাড়ি ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক রয়েই গেছে। কারও নজর আবার প্রকল্পের জন্য কেনা দামি পাজেরোর দিকে। অথচ সরকার চেয়েছিল ক্যাডার কর্মকর্তাদের গাড়ির মালিক বানানোর পাশাপাশি পরিবহণ খাতে খরচের লাগাম টেনে ধরতে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে ‘সে আশায় গুড়ে বালি’। বেশির ভাগ কর্মকর্তা নিজের গাড়ি শোপিস হিসাবে খুবই নতুন রাখছেন। বিপরীতে দপ্তর, সংস্থা, মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্পের জন্য কেনা দামি পাজেরো গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার অব্যাহত আছে। এমনকি প্রকল্প গ্রহণের সময়ই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের টার্গেট করে এসব গাড়ি কেনা হয়। ওই গাড়ির সমুদয় ব্যয়ভার প্রকল্প থেকেই মেটানো হয়। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রথম থেকেই গণমাধ্যমে তথ্যবহুল অভিযোগ ওঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। দফায় দফায় চিঠি দিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সতর্ক করে। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে সম্প্রতি কয়েকটি মন্ত্রণালয় থেকে শীর্ষ কর্মকর্তার প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য পাজেরো গাড়ি কেনা হয়েছে। যা প্রকারান্তরে সচিবদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো মন্ত্রণালয় টিওঅ্যান্ডটিভুক্ত করে সচিবদের ব্যবহারের জন্য পাজেরো গাড়ি কিনেছে। কিন্তু বিশেষ ঋণে কেনা প্রাইভেট কারের বিপরীতে ৫০ হাজার টাকা ভাতা নেওয়া বন্ধ হয়নি। বেতনের সঙ্গে তারা এই ভাতা তুলে নিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘নিয়মের বাইরে গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে আছে। কিছুদিন আগে এ সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে। সামনের দিনে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রথমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পর গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় আমাকে দেওয়া হতো না। চিঠি চালাচালির পর গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় পাচ্ছি। চুক্তিতে থাকা সব সচিব এভাবেই পাচ্ছেন।’

প্রসঙ্গত, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এ সুযোগ নেই। ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা-২০২০ (সংশোধিত)’-এর ১০(৬) ধারা অনুযায়ী, অবসরোত্তর ছুটিকালে অভোগকৃত অবসরোত্তর ছুটি স্থগিত বা বাতিলের শর্তে চুক্তিভিত্তিক বা অন্য কোনো ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের অথবা সরকারের কোনো পদে নিয়োজিত হলে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং অন্য কোনো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য হবেন না।’ যদি কোনো সুযোগে সচিব পুরোনো সুযোগ-সুবিধা পান, সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের গাড়ি সুবিধা পাওয়ার কারণে তিনি ২৫ হাজার টাকা করে তুলতে পারবেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই, নীতিমালা দেখে কথা বলতে হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সিএজি এম হাফিজ উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রধান দায়িত্ব সেই মন্ত্রণালয়ের সচিবের। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হচ্ছেন সচিব। এখন সচিবই যদি দুর্নীতিতে যুক্ত থাকেন তাহলে অন্যরা কী করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’ তিনি বলেন, ‘ঘটনা সত্য হয়ে থাকলে প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকাদের এমন অন্যায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

সড়ক বিভাগে গাড়ি অপব্যবহারের চিত্র : সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও উন্নয়ন) আব্দুল মালেক সরকারের দেওয়া সুদমুক্ত ঋণে কেনা ব্যক্তিগত গাড়ির বিপরীতে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা হিসাবে বছরে সাড়ে সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে তুলছেন। একই সঙ্গে একটি নয়, তিনি সরকারি দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে রয়েছে একটি পাজেরো জিপ (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৮২১৭) ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ব্যবহার করা দুটি গাড়ির জন্য জ্বালানি খরচ তোলা হয়েছে সাত লাখ ৯৮ হাজার।

অতিরিক্ত সচিব রওশন আরা বেগম ব্যক্তিগত গাড়ির বিপরীতে বছরব্যাপী টাকা তোলার পরও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। ব্যবহার করা সরকারি গাড়ির জন্য গত অর্থবছরে ব্যবহার হয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা। যদিও বর্তমানে তিনি পিআরএল-এ আছেন।

অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর্ট) নীলিমা আখতার সুদমুক্ত ঋণের টাকায় কেনা ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা করে তুলছেন। একই সঙ্গে সরকারের একটি পাজেরো জিপ গাড়ি ব্যবহার করছেন। তার ব্যবহৃত গাড়ির নাম্বার ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-০৭৮৮।

মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার একজন যুগ্মসচিব সরকারি ঋণের টাকার গাড়ির খরচ বাবদ প্রতিবছর সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা ভাতা নিচ্ছেন। কিন্তু তিনিও মন্ত্রণালয়ের আরেকটি গাড়ির ব্যবহার করেন। এই গাড়ির বিপরীতে গত অর্থবছরে তোলা হয়েছে চার লাখ ৩৩ হাজার টাকা। সড়ক পরিবহণমন্ত্রীর একান্ত সচিব (যুগ্মসচিব) গৌতম চন্দ্র পাল। তিনিও পিছিয়ে নেই। সরকারের তহবিল থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়ি কিনলেও ব্যবহার করছেন মন্ত্রণালয়ের জিপ। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৮১০০। এই গাড়ির পেছনে এক অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। সচিবের একান্ত সচিব অপূর্ব কুমার মণ্ডল। উপসচিব হিসাবে ঋণ সুবিধা নিয়ে কেনা গাড়ির বিপরীতে তিনিও প্রতি মাসে তুলে নিচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু এর বাইরেও ব্যবহার করছেন একটি সরকারি গাড়ি। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৮১০০। এই গাড়িটির বিপরীতে করোনার মধ্যে গত অর্থবছরে জ্বালানি খরচ তোলা হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার টাকা।

বাজেট শাখার উপসচিব আব্দুল মোক্তাদের প্রাধিকারভুক্ত গাড়ির জন্য ৫০ হাজার টাকা করে তুলছেন। সেই সঙ্গে সরকারের একটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-০১০৫) ব্যবহার করছেন। এই গাড়ির বিপরীতে গত অর্থবছরে সরকারি কোষাগার থেকে তোলা হয়েছে দুই লাখ ৪১ হাজার টাকা। সম্পত্তি শাখার উপসচিব আজিজুর রহমানও প্রাধিকারভুক্ত গাড়ির বাইরে সরকারি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-১৯০৪) ব্যবহার করেন। তার গাড়ির বিপরীতে গত বছরে বিল তোলা হয়েছে দুই লাখ ৫১ হাজার টাকা। তিনি বর্তমানে বাগেরহাটের ডিসি হিসাবে কর্মরত। উপসচিব সালমা বেগমও একই ধরনের সুবিধা পাওয়ার বাইরে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। তার গাড়ির বিপরীতে বিল তোলা হয়েছে তিন লাখ ৩৫ হাজার টাকা। উপসচিব দীপঙ্কর মণ্ডলও একই পথের পথিক। তিনি ঋণ সুবিধার গাড়ির বিপরীতে ভাতা নিচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু ব্যবহার করছেন আরেকটি সরকারি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-২৭৩৯)। এর বিপরীতে তোলা হয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির বাইরে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে গত অর্থবছরে সেসব গাড়ির পেছনে বাড়তি খরচ হয়েছে-উপসচিব সুলতানা ইয়াসমিনের তিন লাখ ৫২ হাজার, উপসচিব শামীমুজ্জামানের চার লাখ ৪২ হাজার, মাহবুবের রহমানের তিন লাখ ৭৮ হাজার, যুগ্মসচিব শফিকুল করিমের এক লাখ ৫৭ হাজার, জাকির হোসেনের পাঁচ লাখ ৪১ হাজার এবং ফাহমিদা হক খানের এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।

মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান দুর্নীতি বিষয়ে সিএজি (কম্পোট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) অফিস উদ্যোগহীন কেন থাকে-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক সিএজি হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকার সময় অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু একা কত পারা যায়? এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে নীতিনির্ধারণ করে দিয়ে মনিটরিং করা। কিন্তু তারাই যদি অনিয়মে জড়িয়ে যায়, তাহলে মন্ত্রণালয়ে অধীনস্থদের কী অবস্থা, সেটি সহজেই বোঝা যায়।’

নীতিমালা অনুযায়ী উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে কর্মকর্তারা সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য সুদমুক্ত ঋণ পান। এসব কর্মকর্তা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও ড্রাইভার খরচ বাবদ প্রতি মাসে খরচ তুলতে পারেন ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি সরকারি দপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করলে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য মাসে ২৫ হাজার টাকা তুলতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ কর্মকর্তাই দুই গাড়ির সুবিধা নেওয়ার পরও ৫০ হাজার টাকা করেই সরকারি কোষাগার থেকে নিচ্ছেন। এভাবে টাকা নেওয়া দুর্নীতির শামিল বলে জনপ্রশাসন থেকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। কিন্তু বাস্তবে এ বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।’

সূত্রঃ যুগান্তরের প্রতিবেদন।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

Recent Comments