fbpx
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
বাড়িরাজধানীভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যার ফতোয়া রাজারবাগ পীরের

ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যার ফতোয়া রাজারবাগ পীরের

ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যার ফতোয়াসহ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মভীরু মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানোসহ বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ উঠেছে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) শাখার তদন্তে এসব অভিযোগ উঠে এসেছে।

গতকাল রবিবার সিটিটিসি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করে। প্রতিবেদন আমলে নিয়ে রাজারবাগ পীরের কর্মকাণ্ডের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির করতে সিটিটিসিকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ।

এ ছাড়া তদন্তের স্বার্থে দুদক, সিআইডিসহ তদন্ত সংস্থাগুলো চাইলে পীর দীল্লুর রহমানসহ মামলাবাজ সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের দেশত্যাগে নিধোজ্ঞা আরোপ করতে পারবে বলে নির্দেশ দেন আদালত। মিথ্যা মামলার শিকার ভুক্তভোগীরা সিআইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী পীরের মামলাবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারবেন। আদালত প্রায় অর্ধশত মিথ্যা মামলার শিকার ভুক্তভোগী কাঞ্চনের আইনজীবীকে বলেছেন, ‘মিথ্যা মামলার পেছনে কারা রয়েছে, তা সিআইডির প্রতিবেদনে উন্মোচিত হয়েছে। এখন ইচ্ছা করলে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে এসব মিথ্যা মামলা দায়েরের সঙ্গে পীর সিন্ডিকেট জড়িত মর্মে সিআইডির দেওয়া প্রতিবেদন বিবেচনায় নিতে হবে।’

রাজধানীর রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার মুরিদদের নিয়ে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে ‘মামলাবাজ সিন্ডিকেট’। বিশেষ করে জমিজমা হাতিয়ে নিতে না পারলেই মিথ্যা মামলা দিয়ে চালায় হয়রানি। সারা দেশে অবৈধভাবে দখলে রেখেছে প্রায় সাত হাজার একর জমি। ইতোমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এবার সিটিটিসির তদন্তে উঠে এলো আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।

হাইকোর্টে দাখিল করা সিটিটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে, তাদের ভাষায় মাল’উনদের হত্যা করা ঈমানি দায়িত্ব উল্লেখ করে ফতোয়া দিয়েছে এবং কতল করার আদেশ দিয়েছে, যা মূলত বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের মানুষকে হত্যা করার ফতোয়ার অনুরূপ। এটি ইসলামের নামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতো একই প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করার ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার কৌশল। তাদের এ ধরনের বক্তব্য মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করবে, অসহিষ্ণু করবে, অসম্প্রদায়িক চেতনা নষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে।’

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ উল্লেখ করে সিটিটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এ পীর এবং তার দরবার শরিফ সামাজিকভাবে কুসংস্কার, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পীর দীল্লুর রহমানের দরবার থেকে প্রকাশিত আলোচিত দুটি পত্রিকা ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ ও ‘দৈনিক আল ইহসান’-এর মাধ্যমে গুটিকয়েক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নানাভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। তাদের এসব কার্যক্রম সরাসরি সরকারি নীতিমালা, দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিবিরোধী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তাদের প্রচার-প্রচারণায় গোপালগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে গোলাপগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরগাঁও, নারায়ণগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরানীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাম পরিবর্তন করে আমানবাড়িয়াসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলা ও স্থানের নাম পরিবর্তন করে সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া তারা ছোঁয়াচে রোগবিরোধী ও বাল্যবিয়ের পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য ও ফতোয়া দিয়ে ধর্মভীরু ও সহজ সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সার্বিক পর্যালোচনায় প্রতীয়মাণ হয়, তারা এখনো জঙ্গি সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত না হলেও তাদের বিভিন্ন প্রকাশনা, বক্তব্য, মুরিদ ও অনুসারীদের প্রতি তাদের নির্দেশনার ফলে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে তাদের এসব বক্তব্য ও প্রচার-প্রচারণা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের ‘লোন উলফ’ হামলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে।’

আদালতে প্রতিবেদনটি দাখিল করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিশির মুহাম্মদ মনির ও এমাদুল হক বশির। পীর দীল্লুর রহমানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জহির হোসেন মুকুল এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে শুনানি করেন জাহিদ হাসান দোলন।

শুনানির শুরুতে দুদকের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তিন মাস সময় চান দুদকের আইনজীবী দোলন। তিনি বলেন, রাজারবাগ পীর ও তার সিন্ডিকেটের ব্যাপারে তদন্তের জন্য দুদক কমিটি করেছে। ৬৪ জেলায় বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে তিন মাস সময় লাগবে। এর পর রাষ্ট্রপক্ষ সিটিটিসির প্রতিবেদন দাখিল করে। এর পর আইনজীবী এমাদুল হক বশির আদালতে বলেন, ‘এটা কোন ধরনের পীর? কোন ধরনের ইসলাম পালন করে তারা? তারা জোর করে জমি দখল করবে, জমি দখল করতে না পারলে মামলা ঠুকে দেবে। এখন তদন্ত রিপোর্টগুলোতে সত্য বের হয়ে আসছে। সারা দেশের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে। পীরসহ চারজন যে কোনো সময় দেশ ত্যাগ করতে পারেন। কারণ, এ চারজনই মূল হোতা, তারাই পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন।’

এর পর আইনজীবী শিশির মুহাম্মদ মনির এ রিট মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন দাবি করে আদালতে বলেন, ‘আমার পেশাগত জীবনের ২০ বছরে এমন হয়রানি আর কখনো পোহাইনি। আমার বাসার সামনে বিশেষ ড্রেস পরিহিত তাদের লোক ঘোরাফেরা করে। আমার স্ত্রীর কর্মস্থলেও তাদের লোকজন ঘোরাফেরা করে। রাত ৩টার সময় আমার স্ত্রীর ফোনে ফোন দিয়ে বলে, তোর স্বামীকে এ মামলা পরিচালনা করতে নিষেধ কর। বাচ্চাটা স্কুলে গেলে রাস্তা আটক করে। এসব কারণে আমি শাহবাগ থানায় জিডি করেছি। আর যে ভাষা ব্যবহার করে, তা প্রকাশ্যে বলা যাবে না। আমার পরিবারকে বাঁচাতে, বাচ্চাকে বাঁচাতে আমার নিরাপত্তা প্রয়োজন।’ সব পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত উপরোক্ত আদেশের পাশাপাশি আইনজীবী শিশির মনিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিপুল বাগমারকে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন।

উল্লেখ্য, একরামুল আহসান কাঞ্চন ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়ের হওয়া ৪৯টি মামলার পেছনে রয়েছে এই পীর সিন্ডিকেট। এসব মামলায় একরামুল এক হাজার ৪৬৫ দিন জেলও খেটেছেন। কিন্তু একটি মামলার বাদীকে খুঁজে না পেয়ে ৫৫ বছর বয়সী কাঞ্চন এসব মামলা থেকে রেহাই পেতে গত ৭ জুন হাইকোর্টে রিট করেন। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডিকে মামলার পেছনে জড়িতদের খুঁজে বের করতে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

আদালতে দাখিল করা সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একরামুল আহসানের তিন ভাই ও এক বোন। ১৯৯৫ সালে তার বাবা আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনে ৩ শতাংশ জমির ওপর তিনতলা পৈতৃক বাড়ি তাদের। বাবার মৃত্যুর পর একরামুলের বড় ভাই আক্তার-ই-কামাল, মা কোমার নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার পীর দীল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু একরামুল ও তার আরেক ভাই কামরুল আহসানকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেও ওই পীরের মুরিদ করা যায়নি। এর মধ্যে একরামুল আহসানের মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির অধিকাংশই পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আর একরামুল ও তার ভাইয়ের অংশটুকু দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করতে পীর দীল্লুর ও তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। এ নিয়ে পীর দীল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের সঙ্গে একরামুলের শত্রুতা তৈরি হয়। ওই শত্রুতার কারণেই একরামুলের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হয়রানিমূলক মামলা করেন পীর দীল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা।

মামলার নথি পর্যালোচনার ভিত্তিতে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরকদ্রব্য আইন, হত্যাচেষ্টা, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ নানা অভিযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী কিংবা ভুক্তভোগীর কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং ওই দরবার শরিফের পীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব মামলা দায়েরের পেছনে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দীল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীদের স্বার্থ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত।

এরই মধ্যে আরও ৮ ভুক্তভোগী হাইকোর্টে গত ১৬ সেপ্টেম্বর রিট করেন। রিট আবেদনে বলা হয়, পীর দীল্লুর রহমান ও তার সিন্ডিকেট রিট আবেদনকারীদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী একাধিক মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে। এসব মিথ্যা মামলায় বেশ কয়েকজন এখনো কারাগারে রয়েছেন। শুধু সম্পদ লিখে না দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়ের করা হয়েছে। দ্বিতীয় এ রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ সেপ্টেম্বর পীর ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সব সম্পদের উৎস খোঁজার জন্য দুদককে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি পীর ও তার পৃষ্ঠপোষকতায় উলামা আঞ্জুমান বাইয়্যিনাত অথবা ভিন্ন কোনো নামে কোনো জঙ্গি সংগঠন আছে কিনা, খোঁজ নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে আদেশ দেন। পাশাপাশি রিট আবেদনকারী ৮ জনের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি সেদিন রিট আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা ও হয়রানিমূলক ক্রমাগত ফৌজদারি মামলা দায়েরে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। হাইকোর্টের এ আদেশ স্থগিত চেয়ে পীর দীল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা আপিল বিভাগে আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হয়। এখন দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা পীর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে। এমন অবস্থায় পীর ও তার সহযোগীরা পালিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রিটকারীদের। গত সপ্তাহে পীর দীল্লুরসহ চারজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন একরামুল আহসান কাঞ্চন।

সূত্রঃ আমাদের সময়।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

Recent Comments