শনিবার রাতে সিআইডির সাইবার সেন্টার মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের সহায়তায় ওই এলাকার সরকার বাজার থেকে গ্রেফতার হয় জাহাঙ্গীর। তার পরই বিভিন্ন প্রতারণার কাহিনী বেরিয়ে আসতে থাকে তার। অভিনবভাবে তরুণী-কিশোরীর ‘ব্যক্তিগত’ ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে নিয়ে তা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন জাহাঙ্গীর আলী (৩২) নামে এক যুবক।
নামে-বেনামে এখন পর্যন্ত তার সাতটি ফেসবুক আইডি ও সাতটি মোবাইল সিমকার্ড পাওয়া গেছে। এসব ফেসবুকের প্রোফাইল পর্যালোচনা করে এরই মধ্যে শতাধিক তরুণীর ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে।
সিআইডির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, জাহাঙ্গীর মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ছবি খুঁজে বের করেন। এ ছাড়া কোনো বাংলাদেশি নাগরিক ইউরোপ-আমেরিকায় ঘুরতে গেলে তার ছবিও সংগ্রহ করেন তিনি। এরপর জাহাঙ্গীর ওই প্রবাসী বাংলাদেশির ছবি দিয়ে নিজে ভুয়া ফেসবুক আইডি তৈরি করেন। তারপর তরুণী-কিশোরীদের টার্গেট করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান তিনি। এরপর তাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গভীর করেন। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর অবিবাহিত তরুণী-কিশোরীদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন জাহাঙ্গীর।
কৌশল হিসেবে তিনি বলতেন, বিয়ের পর হবু স্ত্রীকে ইউরোপে নিয়ে যাবেন। কোনো তরুণী তার প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা বলার পরামর্শ দিতেন। তখন জাহাঙ্গীর বলতেন, তার পরিবারকেও বিয়ের বিষয়টি জানাতে হবে। এ জন্য তিনি ওই তরুণীর আরও কিছু ভালো ছবি চান। তখন হয়তো তরুণী বলতেন, তার ফেসবুক থেকে বাছাই করে ছবি নিয়ে নিতে। তবে জাহাঙ্গীর তার পরিবারের সবার সামনে উপস্থাপন করা যায়, এমন কিছু ছবি পাঠানোর প্রস্তাব করতেন। বিয়ের বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করতে এভাবে টার্গেট করা তরুণীর ছবি নিতেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হলে ওই তরুণীর ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও মেসেঞ্জারে নিতেন। কিছুদিন পর আবার জাহাঙ্গীর জানাতেন, বিয়ে করার জন্য তিনি বিদেশ থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। দু-এক দিনের মধ্যে তরুণীর বাসায় গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলবেন।
এমন কথোপকথনের মধ্যে টার্গেট করা তরুণীকে জাহাঙ্গীর ফোন করে জানান, হঠাৎ তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দ্রুত ভিসা নিয়ে ভারতে যেতে হচ্ছে। কয়েক লাখ টাকা লাগবে। সব টাকা জোগাড় হয়েছে। মাত্র ৪০-৫০ হাজার টাকার ঘাটতি রয়েছে। এটা জানিয়ে ওই তরুণীর কাছে ৪০-৫০ হাজার টাকা চাইতেন তিনি। তখন হয়তো ওই তরুণী বলতেন, এতদিন ইউরোপে থাকার পরও কেন এই অল্প ক’টা টাকা তার মতো লোকের দরকার হবে। তখন জাহাঙ্গীর বোঝাতেন, ঢাকায় ফেরত এসেই একটি গাড়ি ও ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছেন। তাই টাকা-পয়সা নিয়ে একটু ‘সমস্যা’য় রয়েছেন। এ বিষয়টি আবার বিশ্বাসযোগ্য করতে জাহাঙ্গীর বলতেন, যাতে টাকা দেওয়ার বিষয়টি ওই তরুণী তার মা-বাবাকে না জানান। এতে হবু শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে তিনি ছোট হয়ে যাবেন। তখন অনেক তরুণী তাকে টাকা পাঠাতেন। আর যারা টাকা দিতেন না, তাদের ছবি দিয়ে ফেসবুকে ভুয়া আইডি তৈরি করতেন তিনি। আইডি তৈরির ক্ষেত্রে অভিনব কৌশল ছিল তার।
টার্গেট করা তরুণীর ছবি দিয়ে ওই তরুণীর নামে একটি ভুয়া আইডি তৈরি করে তার বন্ধুদের বলতেন আগের আইডি হ্যাক হয়েছে। যেন নতুন আইডিতে তারা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। এরপর ওই তরুণীর ছবি দিয়েই জাহাঙ্গীর আইডি তৈরি করে তরুণীর পরিচিতজনের কাছে ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করে তাকে ফাঁসাতেন। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীর যাদের ফাঁসিয়েছেন তাদের মধ্যে ছাত্রী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মেয়েও রয়েছেন।
জানা গেছে, প্রতারক জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগরের ফকিরাবাদে। এলাকায় তার কম্পিউটারের ব্যবসা রয়েছে। তবে ওই ব্যবসার আড়ালে প্রবাসী সেজে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করে অর্থ উপার্জন করাই ছিল তার মূল কাজ। জাহাঙ্গীরের একটি প্রাইভেটকার রয়েছে। টার্গেট করা তরুণীদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একাধিক নম্বর সরবরাহ করতেন তিনি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিতে একেক সময় একেক এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর সরবরাহ করতেন।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রতারণা করে আসছিল জাহাঙ্গীর। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রয়েছে। আজ রিমান্ড আবেদন করে আদালতে তোলা হবে তাকে। তার সব ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ফরেনসিক পরীক্ষাও করা হবে।’
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খায়রুল আলম জানান, সম্প্রতি একজন ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর শনিবার রাতে তাকে গ্রেফতারের পর তার একাধিক আইডি বিশ্নেষণ করে এখন পর্যন্ত একশ’র বেশি তরুণী-কিশোরীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে।