বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের সব ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিভিন্ন মাধ্যমে সংস্থাটিতে জমা হওয়া অভিযোগ ও গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত দুর্নীতিসংক্রান্ত খবরের সূত্র ধরেই বিমানের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শুরু করেছে অন্তত তিনটি টিম। মিসরীয় দুটি উড়োজাহাজ লিজসংক্রান্ত গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজে অগ্রগতি হয়েছে বেশ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিবিএ-এর ১৭ নেতার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধানও চলছে দ্রুতগতিতে। দেশের চারটি বিমানবন্দর সম্প্রসারণে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি খাতের দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান টিম গঠনের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স সম্পর্কে বেশকিছু অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে এসেছে এবং মিডিয়ায়ও প্রচার হয়েছে। বিমানসংশ্লিষ্ট সব অভিযোগই দুদক গুরুত্বসহকারে অনুসন্ধান করবে। বিমানে যদি কোনো দুর্নীতি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা থেকে যেন তারা মুক্ত হতে পারে সে লক্ষ্যে অনুসন্ধান যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হবে। অনুসন্ধানের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন মনে করবেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ জানা যায়, মিসরীয় দুটি উড়োজাহাজ লিজসংক্রান্ত গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। এ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই-বাছাই করতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। দরকারি ফাইলপত্র চেয়ে তারা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীকে চিঠিও দিয়েছে। চিঠিতে ১৩ ধরনের ডকুমেন্ট চাওয়া হয়েছে।
- জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানের বহর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে মিসরীয় দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়া হয়। লিজ প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। একাদশ জাতীয় সংসদের বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১নং সাব-কমিটি প্রাথমিক তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে গভীরভাবে তদন্ত করার জন্য দুদকে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে অভিযোগটি দুদকে পাঠালে তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ও সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠন করা হয় অনুসন্ধান দল। এই দলের সদস্যরা, বোয়িং দুটির পরিদর্শন প্রতিবেদনের ছায়ালিপি, পরিদর্শন দল গঠন সংক্রান্ত অফিস আদেশ, নোটাংশ ও নথির সত্যায়িত ছায়ালিপি, বিমানের প্রকিউরমেন্ট পলিসি এবং ডেলিগেশন অব ফিন্যান্সসিয়াল অথরিটির সত্যায়িত ছায়ালিপি সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে। এছাড়াও উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্তসংক্রান্ত নথি, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি, নোটসহ পূর্ণাঙ্গ নথির কপিও সংগ্রহের কাজ চলছে।
- উড়োজাহাজ দুটির লিজ নেওয়া থেকে ফেরত দেওয়া পর্যন্ত যাবতীয় ব্যয়ের বিল-ভাউচার, রেজিস্টার, ব্যাংক হিসাব বিবরণীর রেকর্ডপত্রও চেয়েছে অনুসন্ধান দল। কোন কর্মকর্তারা পরিদর্শন কমিটির সদস্য ছিলেন, তাদের নাম-ঠিকানা, ব্যক্তিগত নথি ও পাসপোর্টের কপি এবং মিসরে অবস্থানসংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্রের কপিও সরবরাহের জন্যও সংস্থাটিতে চিঠি পাঠিয়েছে অনুসন্ধান টিম। এছাড়াও বর্তমানে বিমান দুটির অবস্থান, উড্ডয়নের সক্ষমতাসহ আরও কয়েক ধরনের তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ দুটি লিজ নিয়েছিল। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইট পরিচালনার পর বিকল হয়ে যায় একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন। সেটা সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই আরেকটি ইঞ্জিন ভাড়া আনা হয়। দেড় বছরের মাথায় অন্য ইঞ্জিনটিও নষ্ট হয়ে যায়। তখন উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ফের ইজিপ্ট এয়ার থেকে আরেকটি ইঞ্জিন ভাড়ায় আনা হয়। পরে ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। সেই ইঞ্জিন মেরামত করতে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে। মেরামতের জন্য কোনো সময় নির্দিষ্ট করে না দেওয়ায় ইজিপ্ট এয়ার এবং মেরামতকারী কোম্পানির জন্য অর্থ গুনতে হয় বিমানকে। দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজের পেছনে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ বিমানের ক্ষতি হয়েছে ১১শ কোটি টাকা। দুটি উড়োজাহাজের জন্য প্রতিমাসে বিমান ১১ কোটি টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। সেই দায় থেকে ২০২০ সালের মার্চে মুক্ত হয় বিমান।
আরও জানা যায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১৭ সিবিএ নেতার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুদক। আট মাসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকায় কাজও চলছে দ্রুতগতিতে। সংশ্লিষ্ট নেতাদের দুদকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সোমবার বিমানের সিবিএ-এর সহসাধারণ সম্পাদক রুবেল চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রফিকুল আলম ও আবুল কালামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদক কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও বিমানের সাবেক সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মনতাসার রহমান হাজির হননি। রোববার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বিমানের আরও তিন সিবিএ নেতাকে। তারা হলেন তৎকালীন সহসভাপতি আজাহারুল ইমাম মজুমদার, আনোয়ার হোসেন ও মো. ইউনুস খান। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হওয়ার কথা থাকলেও ওইদিন দুদকে হাজির হননি সাবেক সিবিএ সভাপতি ও বর্তমানে বিমানের কানাডা অফিসের কান্ট্রি ম্যানেজার মশিকুর রহমান।
দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত-২-এর উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন জানান, তাদের যেসব কাগজপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছিল, তা তারা দাখিল করেছেন। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। এছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যাদের তলব করা হয়েছে তারা হলেন বিমানের তৎকালীন ফিন্যান্স সেক্রেটারি মো. আতিকুর রহমান, অফিস সেক্রেটারি মো. হারুনর রশিদ, পাবলিসিটি সেক্রেটারি আবদুল বারী লাভলু, স্পোর্টস সেক্রেটারি মো. ফিরোজুল ইসলাম, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারি মো. আবদুস সোবহান, উইমেন্স অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি আসমা খানম বানু, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি গোলাম কায়সার আহমেদ, সদস্য মো. আবদুল জব্বার ও মো. আবদুল আজিজ। এসব নেতার স্ত্রী-সন্তানের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি ও আয়কর রিটার্ন-সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ দুদকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর বিমানের অনিয়ম অনুসন্ধানে ১৭ সিবিএ নেতাকে তলব করে চিঠি পাঠায় দুদক।
জানা যায়, চারটি বিমানবন্দর সম্প্রসারণে দুর্নীতির অভিযোগেরও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। ব্যয়ের হিসাবসহ বিভিন্ন নথিপত্র চেয়ে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ-বেবিচকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নথিপত্র হাতে আসার পর প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক। সম্প্রসারণ প্রকল্পের ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও জমি অধিগ্রহণে জড়িতদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধান দল প্রাথমিকভাবে অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছে। আরও জানা যায়, সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তরে ‘জিম্মি বেবিচক কর্মকর্তা-প্রকৌশলী, দুদকের নাম ভাঙিয়ে খুররামের হুমকি শিরোনামে প্রকাশিত খবরসহ আরও কয়েকটি সংবাদ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া চলছে।