ঢাকার ক্যাসিনোতে প্রতি রাতে লেনদেন হতো শত কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ পৌঁছে যেত রাজনীতির রাঘববোয়ালদের হাতে। প্রভাবশালী কিছু রাজনীতিবিদের হস্তক্ষেপে ক্যাসিনো মালিকদের কিছু বলার সাহস না দেখালেও শীর্ষ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কাছে নিয়মিতভাবে পৌঁছে যেত মোটা অঙ্কের টাকা। তবে গত বুধবার রাজধানীর চারটি ক্যাসিনোয় র্যাবের হানা ও যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পর টনক নড়েছে ক্যাসিনোর মদদদাতাদের। আরও ক্যাসিনো ক্লাবের সন্ধানে এখনো মাঠে র্যাবসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। সন্ধান পেলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন তারা। একই সঙ্গে কাস্টমস্ গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ঢাকায় ক্যাসিনো মেশিন প্রবেশ করেছে তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজধানীতে অবৈধ কোনো ক্যাসিনো বা জুয়ার আড্ডা পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। আর এসবের নেপথ্যে যত প্রভাবশালী জড়িত থাকুক কেন আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর হবে। র্যাব অভিযান শুরু করেছে, পুলিশও অভিযান শুরু করবে।’ জানা গেছে, নেপাল-সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যান্ড নয়, রাজধানীর অন্তত ৭০টি ক্যাসিনো ক্লাব ও বিভিন্ন জুয়ার আসরে প্রতিদিন ৫০ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এর একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় বিদেশে। বহুতল ভবনের ছাদ ও অভিজাত ক্লাবগুলোয় রাতভর চলে জুয়ার আড্ডা। এসব টাকার খনির নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে সামনে থাকা নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় আড়ালে থাকা নেতারাই দিতেন। বেশির ভাগ ক্লাবের সঙ্গে জড়িত রাজনীতির রাঘববোয়ালরা। উঠে এসেছে সংসদ সদস্যসহ শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার নাম। সামনে থাকা নেতারা নিরাপত্তার তদারকি করলেও আড়ালে থাকা নেতারা কলকাঠি নেড়ে তা নিশ্চিত করতেন। শীর্ষ এক যুবনেতার নিয়ন্ত্রণে চলা ক্যাসিনো থেকে শুধু চাঁদা তোলার কাজ করে একসময় কাকরাইলের বিপাশা হোটেলের বয়ের কাজ করা জাকির হোসেন ও গুলিস্তানের আরমান এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। নতুন মডেলের হ্যারিয়ার গাড়ি দাপিয়ে চাঁদা তুলতেন আরমান। দুটি ক্যাসিনোর মালিকানাও রয়েছে তার। কোন ক্যাসিনোর চাঁদার পরিমাণ কত হবে ওই নেতার সঙ্গে বসে তাও ঠিক করে দিতেন আরমান। আর জাকির চাঁদা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় মাসহারা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন। সিঙ্গাপুরে অভিজাত ক্যাসিনো মেরিনা বেতে গিয়ে তারা জুয়াও খেলেন একসঙ্গে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার বলেন, ‘অবৈধ কর্মকান্ডে র বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে। অবৈধ-অনৈতিক কর্মকান্ডে র পেছনে যে-ই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
জানা গেছে, ক্যাসিনো ক্লাবগুলোয় বিদেশি অবয়ব আনতে ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ চারটি দেশ থেকে উড়িয়ে আনা হয় প্রশিক্ষিত সুন্দরী নারীদের। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেওয়া হতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। রাজধানীর মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ইয়ংমেন্স ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে দিনরাত ক্যাসিনোর কারণে আবাসিক খেলোয়াড়রা ক্লাবেই থাকতে পারতেন না। রয়েছে আলাদা মদের বার। রাত গভীর হলেই এসব ক্লাবে কেনাবেচা হতো ইয়াবা। ক্যাসিনো মেশিন না থাকলেও হাউজি-জুয়ার কারণে অনেকটা একই অবস্থা আজাদ স্পোর্টিং, ওয়ারী ক্লাব ও মেরিনার্স ক্লাবের। বনানী আহমেদ টাওয়ারের ২২ তলায় ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব খোলেন চাঁদপুরের ব্যবসায়ী আওয়াল পাটোয়ারি ও আবুল কাশেম। ক্লাবটি চালুর কিছুদিনের মধ্যেই কৌশলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে এক যুবনেতার প্রতিদিন ৪ লাখ টাকা নেওয়ার বিনিময়ে তার মধ্যস্থতায় পুনরায় চালু হয়। এলিফ্যান্ট রোডের এজাক্স ক্লাবেও ক্যাসিনো চলে এক যুবলীগ নেতার মধ্যস্থতায়। ওই ক্লাব থেকে প্রতিদিন ওই যুবনেতা পান ৩ লাখ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেকে বলেছেন, দেশের বৃহত্তর একটি ফেডারেশনের একজন সাধারণ সম্পাদকের প্রত্যক্ষ মদদে অনেক ক্লাবে চলছে ক্যাসিনো ব্যবসা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের কিছু নেতা সম্পর্কে কড়া মন্তব্যের কারণে ওইদিনই তিনি সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। বুধবারের অভিযানের পর অনেক ক্লাব কর্মকর্তা গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ। এদের দাপটে ত্যাগী ক্লাব কর্মকর্তারা কালেভদ্রে ক্লাবে যাতায়াত করেন। জানা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়া ছাড়াও দিলকুশা, ব্যাংক কলোনি, আরামবাগ, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গুলিস্তান, ওসমানী উদ্যান, বঙ্গবাজার এলাকায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে অনানুষ্ঠানিক ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ রয়েছে তেজগাঁও লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, এলিফ্যান্ট রোডের এজাক্স ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, পল্টনের জামাল টাওয়ারের ১৪ তলাসহ বেশ কয়েকটি নামিদামি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে। সেগুনবাগিচার আটটি স্থানে যুবলীগ মহানগরী দক্ষিণের এক শীর্ষ নেতার তত্ত্বাবধানে ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নিয়ে ক্যাসিনো চালানো হচ্ছে। এখানেই মূলত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ছয়জন নেতাসহ অনেকের আনাগোনা রয়েছে। মালিবাগ-মৌচাক প্রধান সড়কের পাশের একটি ভবনে সৈনিক ক্লাব। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের নামে এই ক্লাব চলে। তেজগাঁও লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাবে একসময় মদ বিক্রির পাশাপাশি নিয়মিত বসত ডিজে গানের আসর। নেপালি সুন্দরী তরুণী ও তরুণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে জাঁকজমকভাবে খোলা হয় ক্যাসিনোটি। উত্তরায় এপিবিএন অফিসের উল্টো পাশে একটি ভবন ভাড়া করে ২০১৬ সালে চালু করা হয় আরেকটি ক্যাসিনো।