ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিশেষ করে ডিজিএম, জিএম, নির্বাহী পরিচালক ও ডেপুটি গভর্নররা ঠগবাজ, প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। মন্তব্যে হাইকোর্ট বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি-উন্নয়নের জন্য সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) যেখানে ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সেখানে শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থে তারা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, এটা সাধারন মানুষের জন্য দূর্ভাগ্যজনক।
আদালত বলেন, আর্থিক খাতের এই বিপর্যয়ের জন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।’
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) পরিচালনা পর্ষদ অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে একটি বিদেশি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের করা আবেদনের শুনানির পর এই পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্টে।
হাইকোর্টের বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক বেঞ্চ ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর এমন আদেশ দেন। আইনজীবী ওমর ফারুক সোমবার (৪ ডিসেম্বর) আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
আইনজীবী বলেন, ‘বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ১০ শতাংশের বিদেশি অংশীদার ‘টিজ মার্ট ইনকরপোরেটেড’ গত বছর মার্চে আবেদনটি আবেদনটি করেছিল। বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে) হালদার ও তার সহযোগীরা বিআইএফসি থেকে কী পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে তা নির্ধারণের জন্য একটি স্বতন্ত্র নিরীক্ষক কোম্পানি নিয়োগের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল আবেদনে।
আইনজীবী ওমর ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সে আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দেন। আদেশে বিআইএফসির নতুন চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ এবং নিরীক্ষক কোম্পানি নিয়োগ দিয়েছে।’
আদালত তার আদেশে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে বিআইএফসি-এর চেয়ারম্যান ও স্বাধীন-স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি পরিচালনা পর্ষদ এবং বার্ষিক সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করবেন।
পাশাপাশি, আরও চার জনকে স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। তারা হলেন- সাবেক সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জামিল শরিফ, আইসিএবি-এর সাবেক সহ-সভাপতি মো. মাহামুদ হোসেন এবং মো. শাহাদাত হুসাইন। এছাড়াও এই আর্থিক সংস্থার নিরীক্ষা পরিচালনার জন্য নিরীক্ষক কোম্পানি নূরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আদালত এই নিরীক্ষক কোম্পানিকে বিআইএফসির সম্পদ, বিআইএফসির দায়বদ্ধতা, এর মূলধন, বিআইএফসিতে পৃষ্ঠপোষক অংশীদারদের বিনিয়োগের পরিমাণ এবং পৃষ্ঠপোষক অংশীদারদের বিনিয়োগের পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখবেন বলে জানান আইনজীবী ওমর ফারুক।
আদালত তার পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল থেকে পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আদালত মনে করেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান চালানো।
পর্যবেক্ষণে আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ঠগবাজ ব্যবসায়ী, প্রতারকরা যাতে জনসাধারণের অর্থ আত্মসাৎ করতে না পারে, তার জন্য বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকবেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এদের গোপন আঁতাত, পরিকল্পনা ভেঙে দিতে হবে।’
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। গত বছর এই প্রতিষ্ঠানটির বিদেশি পৃষ্ঠপোষক অংশীদার ‘টিজ মার্ট ইনকরপোরেটেড’ অর্থ আত্মসাৎ, অব্যবস্থাপনাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল বিআইএফসি পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। ‘টিজ মার্ট ইনকরপোরেটেড’র ১০ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে বিআইএফসিতে।
এসব অভিযোগে বিআইএফসি সভাপতির অপসারণ , নতুন করে পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের নির্দেশনা চেয়ে গত বছর হাইকোর্টে আবেদন করে টিজ মার্ট ইনকরপোরেটেড।
একইসঙ্গে পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট ‘সুকুজা ভেনচার লিমিটেড’ ও ‘কাঞ্চি ভেনচার লিমিটেড’ কীভাবে বিআইএফসির পরিচালনা পর্ষদে সংযুক্ত হয়েছে, সেজন্য অংশীদারি এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করারও নির্দেশনা চাওয়া হয়।
এছাড়া, ২০১৫ থেকে গত পাঁচ বছর পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা বিআইএফসির কত টাকা আত্মসাৎ করেছে, তা খতিয়ে দেখতে স্বাধীন-স্বতন্ত্র নিরীক্ষক নিয়োগ এবং পি কে হালদারসহ তার আত্মীয়-স্বজন, সুকুজা ভেনচার লিমিটেড ও কাঞ্চি ভেনচার লিমিটেডের পরিচালক, বিআইএফসির সব পরিচালকসহ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফ্রিজ করে রাখার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল।
আদালত এ আবেদনের শুনানি নিয়ে গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী আদেশ দেন। সে আদেশে বিআইএফসির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি, স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়েছিল। আবেদনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যবেক্ষণসহ আদেশ দিলেন উচ্চ আদালত।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ওমর ফারুক। বিআইএফসির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হাসান আজিম, ব্যারিস্টার মো. মাহফুজুর রহমান মিলন ও মো.সাইফুল ইসলাম সাইফ।
আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করে এই সময়ের মধ্যে এ আদেশ প্রতিপালনের অগ্রগতি জানাতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদেরকে।