ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত যাত্রামোহন সেনগুপ্তর বাড়িটি নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এই স্থানটিতে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ নির্মাণের জন্য ‘নির্ধারিত স্থান’ হিসেবে ঐতিহাসিক ভবনটির সামনের ভেঙে ফেলা অংশে একটি সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
শনিবার (২৩ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারের নেতৃত্বে প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে এ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন।
জেলা প্রশাসনের এই পদক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রানা দাশগুপ্তসহ আন্দোলনকারীরা।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে এবং উচ্চ আদালতে নির্দেশনা মেনে তারা বাড়িটি ‘রক্ষা করেছেন’। সেখানে জাদুঘর করার পরিকল্পনা আছে।
এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম বলেন ‘এটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা। চট্টগ্রামের ইতিহাসের সাথে জড়িত। কিছু দুষ্কৃতকারীরা অবৈধ অনুপ্রবেশ করে বাড়িটি ভাঙচুর করে। এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিটও হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন।’
‘পাশাপাশি ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষা সংবিধানের ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে সাংবিধানিক দায়িত্ব। হাইকোর্টের আদেশ এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব অনুসারে অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে আমরা এটার দায়িত্ব নিয়েছে। এটা রক্ষা করেছি। জাদুঘর করার বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে। ২০১৮ সালের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভায় এ বাড়ির স্মৃতি সংরক্ষণের সিদ্ধান্তও আছে। পরিকল্পনা আছে জাদুঘর করার।’
এখন থেকে বাড়িটিতে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং এর পাহারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে বলেও জানান তিনি।
জেলা প্রশাসনের টিম মূল গেটে লাগানো অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানে অবৈধভাবে অবস্থান করা কয়েকজন নারী-পুরুষকে তারা বের করে দেন। বাড়ির গেট ও দেওয়ালে লাগানো অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সব সাইনবোর্ড ও ব্যানার খুলে ফেলে দেওয়া হয়। গেটে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা সম্বলিত একটি এবং এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনার একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। ভেতরে লাগানো হয় জাদুঘর সংক্রান্ত জেলা প্রশাসনের সাইনবোর্ড।
এছাড়া আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বাড়ির সীমানা দেওয়ালে ‘বিপ্লবী জাদুঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। জেলা প্রশাসনের টিমে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (মেট্রো) সুমনী আক্তার, বাকলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম ও কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তৌহিদুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
বাইরের তালা ভেঙে ভিতরে গিয়ে সেখানে ছয়জন বসবাসকারীর সন্ধান পায় জেলা প্রশাসনের কর্তারা। তাদের বিনা ভাড়ায় থাকতে দেয়ার কথা বলে দখলকারী এম ফরিদ চৌধুরীর লোকজন সেখানে এনেছিল বলে দাবি করেন তারা। বাড়ির ভিতরে তোষক, কাঁথা-বালিশ রেখে একটি কক্ষে থাকছিল। সেখানে রান্নার উপকরণ এবং হাড়ি-পাতিল, পানির বড় জারও দেখা গেছে। পরে তাদের বের করে দেয়া হয়।
সেখানে একটি বেল্টে বাঁধা কুকুরও ছিল। বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণে একটি অংশে বাঁশের খুঁটি গেড়ে ত্রিপল টাঙানো হয়। মূল ফটক ও সীমানা প্রাচীর ধরে বিভিন্ন অংশে সিসি ক্যামেরাও বসিয়েছিল দখলকারীরা। এছাড়া তাদের লাগানো তিনটি নোটিশ বোর্ডও সরিয়ে নেয়া হয়। এসময় উপস্থিত আন্দোলনকারী আনন্দে স্লোগান দিতে থাকেন। তারা বাড়িটির সীমানা দেয়ালের বাইরে ‘বিপ্লবী জাদুঘর নির্মাণের নির্ধারিত স্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়।
ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত রহমতগঞ্জে ১৯ গণ্ডা জমির উপর এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ওই জমিটি পরে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষিত হয়। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি ইজারা নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
যাত্রামোহনের এক স্বজনের কাছ থেকে কেনার দাবি করে আদালতের একটি আদেশ নিয়ে ৪ জানুয়ারি বাড়িটি ভাঙতে যায় এম ফরিদ চৌধুরীর পক্ষের লোকজন, স্থানীয়দের নিয়ে যা ঠেকিয়ে দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
এর আগে শনিবার বিকেল তিনটা থেকে বাড়িটির সামনে শুরু হওয়া অবস্থান কর্মসূচিতে একে একে বিশিষ্ট নাগরিকরা যোগ দেন। উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি শহীদজায়া বেগম মুশতারি শফী, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, নারীনেত্রী নুরজাহান খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রনজিৎ চৌধুরী ও জীনবোধি ভিক্ষু, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন, গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সমন্বয়ক শরীফ চৌহান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদ হাসান, জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা তাপস হোড় ও শ্যামল কুমার পালিত, আওয়ামী লীগ নেতা নঈমউদ্দিন আহমেদ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম মহানগর যুব ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রুবেল পাল।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘ঐতিহাসিক ভবনটি দখলদারদের হাত থেকে রক্ষায় আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এসেছিলেন। তিনি ভবনটি রক্ষার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি নওফেলকে ধন্যবাদ জানাই তিনি তার কথা রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ উনার দৃষ্টি ছিল বলেই কেন্দ্রীয় নেতারা এখানে এসেছিলেন। জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই তারা বাড়িটি রক্ষার পদক্ষেপ নিয়েছে।’